2

কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির অভিযোগ জানিয়ে লিখিত চিঠির মাধ্যমে আইয়ুব কর্তৃক গভর্নর আজম খানের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ

 

শিরোনাম

সূত্র

তারিখ

কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির অভিযোগ জানিয়ে লিখিত চিঠির মাধ্যমে আইয়ুব কর্তৃক গভর্নর আজম খানের পদত্যাগ পত্র গ্রহণ

আজম খানের কাগজপত্র

৭ জুন, ১৯৬২

 

ব্যাক্তিগত ও গোপনীয়

 

রাষ্ট্রপতি ভবন,

রাওয়ালপিন্ডি

৭ই জুন,১৯৬২

প্রেরকঃ ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আয়ুব খান এন.পিকে.এইচ.জে

প্রিয় আজম,

সব রেকর্ড সোজা রাখার উদ্দেশ্যেই ১১ই মার্চ লেখা তোমার চিঠিটার একটা বিস্তারিত উত্তর দেওয়া উচিত ছিল । কিন্তু ওই পর্যায়ে এই কাজটা করতে গেলে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল,যে পরিস্থিতিতে মার্শাল ল থেকে সংবিধান ভিত্তিক সরকার গঠনের মত সহজ একটা কাজ আরও জটিল হয়ে পড়ত । যেহেতু আমি প্রথম থেকেই দৃঢ়প্রত্যয়ী ছিলাম যে একনায়কতন্ত্রকে সাংবিধানিক সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা উচিত।সেহেতু ওই সময় আমি এমন কিছু করার ঝুঁকি নিতে চাইছিলাম না যাতে এই প্রতিস্থাপনের  কাজটা পিছিয়ে যায়। এখন সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় যখন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি গঠিত হয়েছে,আমি বিনা  দ্বিধায় ঐ সকল কাজ করতে পারি যেগুলো প্রায় তিনমাস ধরে আমি করতে পারি নি  ।

তোমার প্রচুর শক্তি ,উদ্যম ও উদ্দীপনা আছে ।এছাড়াও তোমার আছে উদ্যোগী ও প্রত্যয়ী মনোভাব । কিন্তু আর্থিক শৃঙ্খলা অথবা সম্পদের বণ্টন সম্পর্কে  তোমার কোন ধারণাই নেই।যখন তুমি কোন প্রজেক্ট হাতে নাও তোমার মনে হয় অন্যান্য সব কাজ বন্ধ করে পুরো দেশের সম্পদ ঐ কাজে লাগানো হোক । আমি সবসময় তোমার শক্তি ও প্রত্যয়ী মনোভাব এর প্রশংসা করি । এবং আমি এগুলোকে সবসময় দেশের সর্বোচ্চ স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি ।

এর সঙ্গে যদি পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নমূলক প্রচেষ্টার তাৎপর্য সংযুক্ত করি তখন জনাব জাকির হুসেইন এর অনুসারী কে হবে সে ব্যপারে একটা প্রশ্ন থেকে যায় । কারণ তুমি জানই তিনি চিকিৎসাজনিত কারণে তার পদ থেকে সরে দড়িয়েছেন। তাই আমি তোমাকে বেছে নিয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হওয়ার  জন্য। তুমি যেতে চাও নি কারণ তুমি মন্ত্রীপরিষদ ছাড়তে চাও না। পূর্ব পাকিস্তানে সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা আমি তোমাকে আগেই বুঝিয়েছি । তুমি বলেছিলে মন্ত্রীপরিষদ ছেড়ে অন্য কোন পদে যাওয়ার চেয়ে বরং তুমি পদত্যাগ করবে।জাতির সংকট মুহূর্তে একজন সৈনিক এবং দীর্ঘদিনের সঙ্গীর কাছ থেকে এমন উত্তর আমি আশা করি নি। ঐ সময় দেশে কোন সংবিধান ছিল না । এবং আমি চাইছিলাম সরকারী দায়িত্বে যারা আছে তাদের মধ্যে কোন অনৈক্য যেন ধরা না পড়ে। নয়ত ঐ সময়েই আমি তোমার পদত্যাগপত্র গ্রহন করতাম অথবা তোমাকে জোরপূর্বক একটা বিশেষ প্লেনে করে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিতাম।কারন এই কাজটা তোমার ব্যাক্তিগত ইচ্ছা আকাংখার চাইতে অনেক বড় ।

আমি তোমাকে বিস্তারিত নির্দেশনা দিয়েছিলাম এই বলে যে আমি যথেষ্ঠ উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শক্ত ভিত দেয়া এবং তাকে স্বনির্ভর করতে আমাদেরকে সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই করতে হবে।

তুমি সত্যিই তোমার পূর্ণশক্তি আর স্বাভাবিক উদ্যম এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অসাধারণ প্রচেষ্ঠা চালিয়েছিলে। তুমি মানুষকে দুর্যোগের সময় সাহায্য করে তাদের বিশ্বাস অর্জন করেছ। এই জন্য তুমি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু তুমি আরো একটা কাজ করছিলে। ইচ্ছাকৃত অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে তুমি তাদের কোন দাবিকেই না বলনি। তা সে দাবিটা যতই অযৌক্তিক অথবা অসম্ভব হোক না কেন। একারণে দাবি পূর্ণ হলে তুমি প্রশংসা পেয়েছ আর পূর্ণ না হলে দায় বর্তেছে কেন্দ্রের উপর। তুমি এসব ক্ষেত্রে প্রতিরোধের কোন চিহ্নই দেখাওনি। তুমি কেন্দ্রের একজন এজেন্ট ছিলে। তোমার জনপ্রিয়তা যত বাড়বে আমাদের মূলনীতির জনপ্রিয়তাও তত বাড়ার কথা। কিন্তু তোমার আচরণে ফলাফল হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এটা পূর্ব-পাকিস্তানের মনে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি করেছিল যে এই অনিচ্ছুক ও অসহানভূতিশীল কেন্দ্রের কাছ থেকে যে কোন কিছু পেতে তাদের অবিরাম যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। তুমি একবারও তাদেরকে পূর্ব-পাকিস্তানের উন্নতি সম্পর্কে আমার সত্যিকার মনোভাব জানাওনি। এটাও জানাওনি যে আমি এই উন্নতিকে কি গুরত্বের সঙ্গে নিয়েছি। তুমি একবারও তাদেরকে আমাদের সীমাবদ্ধতার কথা বোঝানোর চেষ্টা করনি। বিদেশ থেকে সাহায্য পেতে আমাদের কষ্ট, বিশেষ প্রকল্পে অন্যান্য দেশের ঋণ ও সাহায্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অথবা জাতীয় স্বার্থে পরিকল্পিত একটা অর্থনৈতিক অবস্থার কথা তারা কিছুই জানেনা। তুমি বল তুমি “পরম আনুগত্য ও ভক্তি ” এর সঙ্গে কাজ করেছিলে। কিন্তু আমি এটাকে সংশোধন করে বলছি, তুমি পূর্ণশক্তি ও উদ্যমে কাজ করেছিলে। বলতে দুঃখ হচ্ছে তোমার পরম আনুগত্য ও ভক্তিকে তুমি জলাঞ্জলি দিয়েছিলে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির হাতছানিতে। ফলাফল তাই অনিবার্য ছিল। আমি তোমাকে প্রতি পদে পদে সাবধান করেছিলাম। পাকিস্তান বিরোধীদলগুলো তোমার এই কাজের ধারার সুযোগ নিয়েই পূর্ব-পাকিস্তানে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে জাতীয় স্বার্থে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছিল। যখন এটা তুমি বুঝতে পারলে তখন তুমি আইন শৃঙ্খলা যুক্তবিতর্কিত বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া শুরু করলে। তুমি বলেছ “তোমার আন্তরিক পরামর্শ সংবিধানসহ বিভিন্ন বিষয়ে উপেক্ষিত হয়েছে।” আমার জানামতে তোমার শুধুমাত্র একটাই পরামর্শ ছিল। সেটা ছিল দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য মার্শাল ল-ই সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি এবং সংবিধান পরিবর্তনের ব্যপারটা বর্তমানে স্থগিত রাখা উচিত। আমি মনে করি ব্যাক্তি নয় প্রতিষ্ঠানই সরকারের আসল অস্ত্র। তাই আমার মনে হয়েছিল আমাদের এমন কিছু প্রতিষ্ঠান তৈরী করা উচিত যেগুলো আমাদের পক্ষে কাজ করবে। আমি তোমার পরামর্শ উপেক্ষা করিনি। আমি ওটা নিয়ে ভাল মত চিন্তা করে ওটা গ্রহন না করার সিদ্বান্ত নিয়েছি। গভর্নর কনফারেন্সে সংবিধান কমিশন ও ক্যাবিনেট কমিটি গঠনের সময় তুমি কিছু পরামর্শ দিয়েছিলে যা পূর্ব-পাকিস্তানি বুদ্বিজীবিদের বক্তব্যের সাথে মিলে যায়। এগুলো আমাদের আগে থেকেই জানাছিল। এবং এগুলো নিয়ে ভালমতো ভাবাও হয়েছিল। তাছাড়া তুমি এগুলো সমর্থনের জন্য আর কোন বাড়তি প্রচেষ্টা চালাওনি। এরপরে তুমি বলেছ আমি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যপারে তোমাকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নিই। আমার মনে হয় তুমি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের গ্রেফতার এর কথা বলছ। মি.সোহরাওয়ারদী সেই সময়ে পশ্চিম-পাকিস্তানে ছিলেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে পাকিস্তান বিরোধীদলগুলোকে প্রস্তুত করছিল সংবিধান এর বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। এই ব্যপারে তোমারই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তুমি ঐ সময় নিজের জনপ্রিয়তা নিয়েই বেশী চিন্তিত ছিলে।আমার দেওয়া নির্দেশ পালন করা যা কিনা তোমার দায়িত্ব ছিল, সে দায়িত্ব নিয়ে তোমার কোন চিন্তাই ছিলনা। কিন্তু আমি দেশের প্রতি আমার কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারিনা। এজন্য তাকে করাচিতেই গ্রেফতার করা হয় আর একজন মন্ত্রীকে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে করে ঢাকা পাঠানো হয় তোমাকে এই তথ্য জানানোর জন্য। আমি জানিনা এর বেশী কি করা সম্ভব ছিল আমার পক্ষে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম তুমি এধরনের বিশ্রী অবস্থা মোকাবেলা করতে গিয়ে যথেষ্ট অরুচিকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলে। তাই এই ব্যপারে আমার অসন্তোষ জানানোটা আমার দায়িত্ব ছিল।তাই তুমি যখন তাড়াহুড়ো করে পদত্যাগ পত্র জমা দিলে ,ওটা গ্রহণ করা ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা। এই কথাগুলো আবার আলোচনায় আসায় আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তোমার পদত্যাগ পত্রে বেশ কিছু মনগড়া যুক্তি থাকায় একটা পূর্ণ উত্তর দেওয়া দরকারী ছিল।

 

আন্তরিক শুভেচ্ছার সঙ্গে

তোমার বিশ্বস্ত,

ল্যাফট. জেনারেল মোহাম্মদ আজম খান