13

বাংলাদেশ রিলিফ কমিটি অব কোরিয়া’-র সাধারণ সম্পাদকের চিঠি

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
কোরিয়া টাইমস সম্পাদকের নিকট ‘বাংলাদেশ রিলিফ কমিটী অফ কোরিয়া’ এর সাধারন সম্পাদকের চিঠি বাংলাদেশ ডকুমেন্টস ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

 

মি. হং সুক-জা, মহাসচিব,

বাংলাদেশ ত্রান কমিটি কোরিয়া,

প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৯, ১৯৭১.

আমি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে আপনার চিঠিটা পড়ছি যেখানে পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এর মর্মান্তিক ঘটনার শুরু এবং কোরিয়ার তৎপর ভুমিকার কথা উল্লেখ আছে। কোরিয়ার বাংলাদেশ ত্রান কমিটির মহাসচিব এর মতে – এটা তার উপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল কিছু ভুল বোঝাবুঝির অবসান করা।

আমি মি. কিম মু চাং এর সাথে একমত যে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) সাথে পাশবিক নির্যাতনের মূল কারন ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১২০০ মাইল দূরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের আচারণ ছিল উপনিবেশিক এর মত।

যদিও পূর্বাঞ্চলের লোকসংখ্যা পশ্চিমাঞ্চল থেকে বেশি ছিল। নির্দিষ্ট উদাহরণস্বরুপ, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার ৬০-৭০ ভাগ আসত পূর্ব পাকিস্তানের উৎপাদিত পন্য (চা,পাট ইত্যাদি) থেকে। কিন্তু সমস্ত মিল-কলকারখানা গড়ে উঠেছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে।

বৈদেশিক সহযোগীতার ক্ষেত্রেও একই ধরনের বৈষম্য দেখা যায়। বৈদেশিক অনুদান বা সহযোগীতার সিংহভাগই অযথা ব্যায় করা হত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আর অবশিষ্ট ক্ষুদ্রাংশ বরাদ্দ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র ২০টির মত পরিবার (বেশি হবে না) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এর প্রায় সাড়ে ৭ কোটি মানুষের অর্থনীতি!

উল্লেখিত সত্য যে, পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) জনগন অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়ে আসছিল এবং এই ব্যাপারটা তারা আর মেনে নিতে পারছিল না।

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের আগ পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটদানের মাধ্যমে নির্বাচিত কোন গণতান্ত্রিক সরকার ছিল না। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে, প্রথম প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামিলীগ এর পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিনিধিত্ব করেন এবং ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। সেই সাথে পূর্বাঞ্চলের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে আওয়ামিলীগ ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করেন। গণতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী শেখ মুজিবুর রহমান তার দলের ১৬৭ জন প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় সমাবেশে অংশগ্রহন করার কথা এবং সেখানে শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয় বরং সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল।

আওয়ামি লীগের ৬ দফা দাবী যা পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এর শায়ত্বশাসনের মূল দলিল হিসেবে পরিচিত, এই দলিল সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তান এর মিলিটারী শাসকরা খুব ভালোভাবে অবগত ছিল। এবং এই কাগজের দশ লক্ষাধিক কপি করানো হয় যা নির্বাচনের সময় প্রচারনার কাজে ব্যাবহার করা হয়।

সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর আওয়ামিলীগ এর সায়ত্বশাসন এর দাবী না ছিল হঠাৎ উন্নয়নের পদক্ষেপ না ছিল কোন গোপন আন্দোলন। কিন্তু যা ঘটেছিল তা হল পাকিস্তানী মিলিটারী শাসকরা শেখ মুজিবুর রহমান এর জনপ্রিয়তা ও তার আওয়ামিলীগ কে পূর্বাঞ্চলে অবমূল্যায়ন করেন এবং এই দুর্বার বিজয়ে তারা এতটাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছিল যে, তারা কিছুই ভাবতে পারল না এবং তাদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাত থেকে তারা নরপিচাশীয় গণহত্যা শুরু করে যেটা ছিল কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ। সামনের দিকে দেশ বিভাজিত হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারী শাসকরা এই দেশে তারা আত্নঘাতি হামলার পথ বেছে নেয়।

যার ফলস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৮ মিলিয়ন লোক প্রতিবেশী দেশ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। কিন্তু চিন্তার বিষয় এই যে, এই উদবাস্তু বা শরণার্থীদের সংখ্যা সুইজারল্যান্ড আর নিউজিল্যান্ড এর দুই দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি।

এই বিশাল আশ্রয়প্রাপ্ত জনসংখ্যা ভারতের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে হুমকিস্বরূপ। এটা একটা ভয়ংকর ব্যাপার। অনির্দিষ্ট সময়ে জন্য এই বিশাল জনগোষ্ঠীর খাবার, আশ্রয় এবং মেডিকেল সুবিধা প্রদান করা অপ্রত্যাশিত।

বহির্বিশ্ব থেকে প্রাপ্ত সাহায্য (যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রাপ্ত কিছু সহায়তা সহ) এই বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় সাহায্যের তুলনায় খুবই নগন্য।

আমরা কোরিয়ায় বাংলাদেশ ত্রান কমিটি করার ব্যবস্থা করলাম, আর আমাদের আশা ছিল এই রকম যে, গরিবের পয়সা ধনীর পাউন্ড থেকে বেশি দামী। আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে অবগত ছিলাম কিন্তু আমরা অবশ্যই সাহায্য করব যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য হয়।

অতঃপর কিছু মাস পরে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের ১৬৭ জনপ্রতিনিধি তাদের দেশের নাম ঘোষনা করল এবং নাম দিল বাংলাদেশ। এই এলাকার গনতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্তকে আমাদের সম্মান করতেই হবে।

প্রাসঙ্গিকভাবে এটা স্মরণ করা দরকার যে জাপানের শাসনামলে আমাদের কে “জাপানের উপদ্বীপ ” হিসেবে অভিহিত করা হত, এবং একইভাবে তাইওয়ান কে “জাপানের দ্বীপ” হিসেবে উল্লেখ করা হত। আমি কতটা আনন্দ অনুভব করতাম যখন বহির্বিশ্ব আমাদের কোরিয়ান হিসেবে জানত, জাপানের উপদ্বীপ হিসেবে না। আমরা ওইদিনগুলোর কথা ভূলে যাই নি।

আমরা পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এর স্বাধীনতার জন্য অন্তত এইটুকু করতে পারি, সারাবিশ্ব যাতে তাদেরকে তাদের নিজস্ব পরিচয়ে ডাকে যেই নামে তারা পরিচিত হতে চায়।