লক্ষ্য

অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে চাই। কোথা থেকে শুরু করবো?প্রশ্নটা ক্রিটিকাল। বাজারে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হরেক পদের কিতাব রয়েছে। তবে বেশীরভাগ বইয়ে একটা প্রগাঢ় সমস্যা রয়েছে, রাইটাররা ইতিহাস জানানোর পাশাপাশি সেই ঘটনার নিজস্ব ব্যাখ্যাটাও সাথে ইনকর্পোরেট করে দেন। অর্থাৎ ইতিহাস আংশিক পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পরে। তাই আর্টিকেল/ব্লগপোস্ট/স্টাটাসে উনাদের ব্যাখ্যা পড়ার পাশাপাশি আপনাদের বেয়ার সোর্সগুলো সম্পর্কেও ক্লিয়ার আইডিয়া রাখতে হবে। নতুবা আপনি ক্রমশঃ উনাদের ফিলোসফির প্রতি উইক হয়ে পড়বেন। মানুষের মন বড়ই দুর্বল জিনিস।

পাশাপাশি আরেকটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, ইতিহাস-আশ্রয়ী গল্প/উপন্যাস/কবিতা সুখপাঠ্য হলেও কখনই যেন তা ইতিহাসের ‘রেফারেন্স’ হিসেবে না-আসে। ইতিহাস নির্ভর ফিকশন বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সাহিত্যমাধ্যম। তবে বাইরের দেশে সে সকল বইয়ের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করা থাকে যে, এটা নিছকই একটা ‘ফিকশন’, একে ইতিহাসের ‘রেফারেন্স’ হিসেবে উল্লেখ করা যাবে না।কিন্তু আমাদের দেশের আমজনতা একথা বুঝতে চান না। উনাদের কাছে বিভিন্ন ঔপন্যাসিকের লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ক একটি উল্লেখযোগ্য রেফারেন্সমাধ্যম, যা সর্বাংশে একটি ভুল ধারণা।তাই আমাদের প্রয়োজন একটি ‘স্টেবল এন্ড অফিশিয়াল’ রেফারেন্স মাধ্যম, যেখানে রাইটারের নিজস্ব ফিলোসফি ইনকর্পোরেট করা হয় নাই।

এক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ হিসেবে তথ্য মন্ত্রণালয় হতে প্রকাশিত এবং হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ সংকলনটির নামই সর্বাগ্রে চলে আসবে। এর একটা স্পেশাল বৈশিষ্ট আছে। ‘৭২ সালে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা একাডেমির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টেশন শুরু করেন।পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের দলিল লিপিবদ্ধ করার জন্য ’৭৭ সালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান পুরোদমে এই প্রজেক্ট হাতে নেন। ‘৮২ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের হাতে দলিলপত্রের ফার্স্ট প্রিন্ট আসে। ’০৩ সালে চারদলীয় আমলে হয় পুনঃমুদ্রন। আবার ’০৯ সালে আওয়ামী গভমেন্টের আমলে রিপ্রিন্ট। অর্থাৎ এই বইটির প্রকাশনায় সকল দর্শনের গভমেন্টই কমবেশী কাজ করেছে  তাই এখানে রক্ষিত ডকুমেন্টসকেই নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রাইমারি সোর্স হিসেবে বিবেচনা করা যায়।প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে ’৭৭ সালে কাজ শুরু করেছিলেন দৈনিক বাংলার প্রাক্তন সম্পাদক হাসান হাফিজুর রহমান। উনি একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম সংকলন রিলিজ করার জন্য বিখ্যাত। উনার সেই সংকলনে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ এবং একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসি নি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছিল। উনি লেফটিস্ট ছিলেন। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন।মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্টস প্রামাণ্যকরণের কাজে নিয়োজিত ছিল ৯ সদস্যের টিম, হেডেড বাই তদকালীন ঢাবির প্রো-ভিসি এবং ইতিহাসের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবির। আরো ছিলেন বর্তমান বাংলা একাডেমির হেড, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ওখানে ডঃ আহমদ শরীফও ছিলেন, তবে উনাকে ’৭৯ সালে কমিটি থেকে বাদ দিয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরির ডিরেক্টরকে কো-অপ্ট করা হয়। তাঁকে ঠিক কোন কারণে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা আজও এক রহস্য। তবে সময়ের সাথে সাথে আরো অনেক রহস্যের মতোই তা সলভড হয়ে যাবে।প্রিন্টিং শুরু ’৮২ সালে। ৪ খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর হাসান হাফিজুর রহমানের আকস্মিক মৃত্যুবরণে প্রজেক্ট ডিরেক্টর হিসেবে দুইজন ডেপুটি সেক্রেটারিকে কিছুদিনের জন্য পিডির চার্জ দেয়া হয়েছিল, তারপর ’৮৩ সালে ঢাবির ইতিহাসের অধ্যাপক কে, এম মহসীনকে পিডির চার্জ দেয়া হয়। উল্লেখ্য, কিছু খন্ডের মুদ্রণকাল ১৯৮২। আর কিছু খন্ডের মুদ্রণকাল ১৯৮৪। শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ বাধাই-এর কাজ অসম্পূর্ণ ছিলো। তাই বিক্রয় শুরু করার তারিখ হিসেবে ১৯৮৫-কেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশের সময়কাল হিসেবে গ্রহন করা উচিৎ।সাড়ে তিন লাখ ডকুমেন্টস থেকে ভ্যারিফিকেশন শেষে ১৫ খণ্ডের এই সংকলন প্রস্তুত করা হয়েছে, পৃষ্ঠা সংখ্যা এরাউন্ড ১০,৮৮৯। দামও ১৫,০০০ টাকার কাছাকাছিই হবে, যদিও বইয়ে দামের কোন উল্লেখ নাই। ওজন এক মণ। পড়তে গেলে খেই হারিয়ে ফেলবেন। তাই না-কিনেই অনলাইনে প্রাপ্ত ফ্রি ই-বুকটি ডাউনলোড করে নিবেন।

প্রকল্পের ১ম পর্যায়ে অর্থাৎ ২৫ জুলাই ২০১৫ থেকে ১৫ জুলাই ২০১৭ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য ছিল নিম্নরূপঃ

১) দলিলপত্রের ২০০৯ সালের প্রিন্টের ১৫টা ভলিউম অনুবাদ করে জনতার জন্য এই ওয়েবসাইটে ও অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে অবমুক্তকরণ ও বিনামূল্যে ডাউনলোডে ব্যবস্থাকরণ।

২) প্রকল্পের অফিশিয়াল পেজ ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র থেকে বলছি’ থেকে প্রতিদিন দলিলপত্র প্রচার।

৩) অফিশিয়াল সাউন্ডক্লাউড, ইউটিউব এবং ফ্লিকার প্রোফাইলে আমাদের সকল রেডিও, টিভি ও পেপারপত্রিকার প্রোগ্রামসহ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বেসিক কাজ ও হাজারখানেক ফ্রি-তে ডাউনলোডেবল হাই রেজুল্যুশনের ছবি তুলে ধরা।

-সুদীর্ঘ ২ বছর মেয়াদী প্রকল্পের ১ম পর্যায়ে আমরা উল্লিখিত সকল কর্মসম্পাদন করতে পেরেছি। সেই সাথে আমরা আরো কিছু জেনেছি যেমন,

১৯৮২ সালে দলিলপত্রের প্রথম প্রিন্ট এসেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। কিন্তু ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে চারদলীয় জোটের হাতে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দলিলপত্র প্রিন্ট নেয়ার পর দেখা যায় যে সেখানে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে রয়ে গেছে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম।

তাই তদকালীন সরকার ২০০৪ সালের জুন মাসে সদ্য গঠিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দলিলপত্রের আরেকটি প্রিন্ট আনে, যা ২০০৯ সালে হাইকোর্ট থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয় কারণ সেই প্রিন্টে দলিলপত্রের ৩য় খণ্ডের প্রথম পৃষ্ঠাটি মুছে দেয়া হয়। সেটা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত।

ব্যাপারটা হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ২০০৯ সালের ২১ জুন, বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক এবং বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে রায় দেন। রায়ে জোট সরকারের শাসনামলে প্রকাশিত ও মুদ্রিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খণ্ডকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পরিপন্থী বিবেচনায় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করে এর প্রকাশনা, মুদ্রণ, বিক্রি ও বিতরণ নিষিদ্ধ করে।

কিন্তু আমাদের মাঝে খুব সীমিত সংখ্যক মানুষ জানি যে, ১৯৮৮ সালে দলিলপত্রের আরেকটি প্রিন্ট বেরিয়েছিল, যা ছিল ১৯৮২ সালের মূল ১৫ খণ্ড দলিলপত্রের সংক্ষিপ্তরূপঃ এক খণ্ডে। আগামী ১ বছর আমরা ১৯৮২, ২০০৩ এবং ২০০৯ সালের ডকুমেন্টের সাথে ক্রসচেক করে ১৯৮৮ সালের এক খণ্ড দলিলপত্র জনতার জন্য উন্মুক্ত করবো।

প্রকল্পের ২য় পর্যায়ে অর্থাৎ ১৪ ডিসেম্বর ২০১৭ থেকে ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য নিম্নরূপঃ

১) মিনিমাম ১২টি অফলাইন কর্মকাণ্ড একজিকিউশন

২) মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র সংবলিত ১৯৮৮ সালের পূর্ণাঙ্গ ভলিউমটি ইউনিকোডে রূপান্তরের মাধ্যমে জনতার জন্য উন্মুক্তকরণ এবং এর সাথে ২০০৯ সালের ডকুমেন্টস ক্রসচেক

৩) জেনোসাইড ক্যাম্পেইন

৪) পূর্বতন প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট সংখ্যক দলিলপত্র ফাইন টিউনিং

-আশা করি সকলেই সাথে থাকবেন। যে কোন প্রশ্নের উত্তর জানতে কিংবা সহায়তা করতে চাই প্রকল্প পরিচালকের ফেসবুক আইডিতে মেসেজ পাঠাতে পারেন 🙂