5

শেখকে হত্যা করতে ইয়াহিয়ার প্রস্তুতি

 

আমরা বাংলাদেশের মানুষের সর্বংসহা হয়ে গেছি।

সামরিক আদালতের নুন্যতম আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়ার  খুন করতে চাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তাই আমরা আর অবাক হই না। এই অসুস্থ ফ্যাসিস্টদের কাছ থেকে এরচেয়ে সভ্য ব্যাবহার কেউ আশাও করে নয়া। এতদিনে এটা বোঝা হয়ে গেছে যে এরা মানুষ আর পশুকে আলাদা করা মানবিকগুনাবলিশূন্য শুধু তাই নয় বরং অহমিকার নেশায় এতই অন্ধ যে নিজেদের আসন্ন পতনও তারা দেখতে পাচ্ছে না । মানবতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সংগঠিত তাদের অপরাধগুলো বিশ্বের কাছ থেকে ঢাকতে ব্যার্থ হয়ে তারা এখন ভান করাও ছেড়ে দিয়েছে। তাই তাদের সভ্যাসমাজের কাছে ঘৃণ্য তাদের পরিকল্পনাগুলোও এখন তারা প্রচারমাধ্যমে প্রচার করে বেড়াচ্ছে। সভ্য সমাজ যে ঘৃণায় শিউরে উঠছে তাতে তাদের আর কিছুই যায় আসে না।

 

ন্যায়বিচার এবং উদারতা বলে কোনকিছু এই কাপুরুষদের অভিধানে নেই। ইয়াহিয়া এবং তার সহযোগী জেনারেলদের কাছ থেকে শেখ মুজিবের প্রতি কোন সভ্য ব্যাবহার আশা করাও বোকামি। শেখ সাহেব, যদি চাইতেন তবে তিনি পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু একজন সাহসী গণতন্ত্রী এবং সভ্য ব্যাবহারের প্রতি চুড়ান্ত আস্থাশীল হওয়ায় তার কাছে এটা অসম্মানজনক মনে হয়েছিল। তবে তিনি বুদ্ধিমান ছিলেন একদিকেই সব ঝুকি না নেয়ার মত। তাই তিনি তার পার্টির লোকদের পাকিস্তানি সৈন্যদের রণোন্মাদ হয়ে গেলে তাদের  নাগালের বাইরে আশ্রয় নিতে বলেছিলেন।২৫শে মার্চ রাতে সেনাবাহিনী এসে তার বাড়ি ঘিরে ফেলে গুলি চালানো শুরু করেছিল। বিপুল নৈতিক শক্তির মানুষ শেখ মুজিব ব্যাল্কনিতে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং আর্মি অফিসারকে বলেছিলেন তাকে গ্রেফতার করে এই অর্থহীন গুলিবর্ষন থামাতে। কাপুরুষ টিক্কা খানের কাছে এটা ছিল একটা বিশাল বিজয়। সবরকম মানবিকতাশুন্য টিক্কা খান তার বন্দিকে মেরে ফেলতে পারলেই খুশি হত কিন্তু ইয়াহিয়া চেয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালির সাহসী নেতাকে নিয়ে আরেকটু খেলতে। তিনি রক্তপিপাসু টিক্কা খানকে বিশ্বাস করতে পারেননি। শেখ মুজিবকে শীঘ্রই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বাংলাদেশে গনহত্যা যতই চলছিল শেখ মুজিবকে ততই রাজনৈতিক আপোষের দিকে, যা বাংলার জনগণকে রাজনৈতিকভাবে বিক্রি করেদিবে তার দিকে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা চলছিল। কিন্তু মদ ও ক্ষমতার মোহে মত্ত ইয়াহিয়া জানতেন না শেখ মুজিব কি ধাতুতে তৈরি। শারীরিক নির্যাতনের সাথে হুমকির মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পিপাসু বাঙ্গালির বিশ্বাসের অমর্যাদা করেননি। ফলাফল হিসেবে কোর্ট মার্শালের হুমকিও একসময় চলে আসল। যেভাবে বিশ্বের কিছু বড় পরাশক্তি পাকিস্তানের পাশে ছিল টাটা এটা অস্মভব কিছু ছিল না যে শেখ মুজিবুর রহমানকেও হত্যা করা হবে বিশ্ববিবেককে পাট্র্যিস লুমুম্বার মত আরেক দেশপ্রেমিকের স্মৃতিভার বয়ে বেড়াতে হবে। এবং খুনিরা এখানেই থামবে না। ঢাকার ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় গৃহবন্দি হয়ে থাকা শেখ মুজিবের পরিবারকেও বাচিয়ে নাও রাখা হতে পারে।

 

কারো মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে জাতিসংঘ এ সময় কি করছিল? জাতিসংঘের নাকের ডগাতেই মৈসে সোম্বের নেতৃত্বাধীন কাটাঙ্গা ফ্যাসিস্টদের হাতে লুমুম্বা মারা যান কিন্তু জাতিসংঘ সেখানে কিছু করার চেষ্টা অন্তত করেছিল। জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ড্যাগ হ্যামারস্কোল্ড প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন সমধান খোজার জন্য। শেখ মুজিবের সম্ভ্যাব্য হত্যায় লুকিয়া থাকা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কতটা হুমকির সম্মুখীন হতে পারে সে বিষয়ে উ থান্ট অন্তত নিরাপত্তা পরিষদকে সাবধান করতে পারতেন। লক্ষন অবশ্য দেখা যাচ্ছে জাতিসংঘ বাংলাদেশের ব্যাপারে নড়েচড়ে বসেছে ভারতের বিরুউধে ইয়াহিয়ার যুদ্ধ হুমকির পরে।

কিন্তু জাতিসংঘের মধ্যে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী ভারত ও পাকিস্তানে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়লে একটি সমঝোতার পন্থা উদ্ভাবন করেই তাদের প্রকৃত দায়িত্ব এড়াতে চায়।কিন্তু প্রকৃত ইস্যু, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইস্যুকে এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ এড়িয়েই গেছে।  কিন্তু এটাও স্পষ্ট যে তারা বাংলাদেশকে নিয়ে যেকোনরকম ইন্দো-পাক শোডাউন এড়াতে চায়। কিন্তু তাদের বোঝার সময় এসে গেছে যে ভারত নয় বরং পাকিস্তানই এখানে একটি ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে যখন তারা বুঝতে পারবে যে তারা আর বাংলাদেশকে আয়ত্তে রাখতে পারবে না। প্রচুর অর্থ-সৈন্য খরচ করে তারা কোনমতে বাংলাদেশের শহরগুলোতে নিয়ন্ত্রন রেখেছে। কিন্তু উত্তরোত্তর আগ্রাসী হয়ে উঠে মুক্তিবাহিনী সেটাকেও দুঃসহ করে তুলছে। মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া চীনের সাহায্য কামনা করেন এবং চীনকে রাজি করান বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে ২০০ বিশেষজ্ঞ দিয়ে যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নড়বড়ে সামরিক কৌশল ও পরিকল্পনাকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের মাটিতে চীনা বাহিনীর উপস্থিতি এ এলাকাকে সেই রক্তস্নানের দিকে আরেকধাপ ঠেলে দেবে যার আশংকা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা করে আসছিলেন। নিঃসন্দেহে সময় এসে গেছে জাতিসংঘের কিছু একটা করার, শুধু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে তথাকথিত পর্যবেক্ষক পাঠানো নয়। আরও বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় অনৈতিক এবং অবৈধ পাকিস্তানি সরকারকে বাংলাদেশের মাটি ছাড়তে বাধ্য করা।

এবং আমরা, আমরা প্রতিহত করব যুদ্ধক্ষেত্রে। ইয়াহিয়াকে আমরা মনে করিয়ে দেব লুমুম্বার হত্যাকারীর নিজের পরিণাম কি হয়েছিল। সোম্বেকে শুধু তার কাটাঙ্গাই হারাতে হয়নি, বরং তাকে অমর্যাদাকর মৃত্যুও বরন করতে হয়েছিল। ইয়াহিয়ার নিজের পরিনতিও এরচেয়ে সম্মানজনক হবে না।

২৪ ও ২৮ জুলাই,১৯৭১