1

সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সম্মেলনে জনাব আতাউর রহমান খানের ভাষণ

শিরোনাম

সূত্র

তারিখ

সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ সম্মেলনে জনাব আতাউর রহমান খানের ভাষণ

 

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ

২৭শে এপ্রিল ১৯৫২

সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ-সম্মেলন বার এসোসিয়েসন হল, ঢাকা ২৭শে এপ্রিল, ১৯৫২ সভাপতি জনাব আতাউর রহমান খানের ভাষণ বন্ধুগণ, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবী করার অপরাধে পূবর্ব পাকিস্তানে যে বিপর্যয় ও বিভীষিকার ঝড় বয়ে গেল তার একটা মোটামোটি ইতিহাস আপনাদের সামনে পেশ করতে চাই। উনিশ শ আটচল্লিশ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রথম উৎপত্তি, ছাত্রসমাজের উপর মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতন ও আন্দোলনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উত্থাপন এবং শেষ পর্যন্ত তখনকার পূবর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, খাজা নাজিমউদ্দীনের চুক্তিপত্র স্বাক্ষর- সবই আপনারা জানেন। আপনারা এও জানেন যে, উক্ত চুক্তির শৰ্ত্ত কখনও কার্যকরী করার চেষ্টা হয়নি, পক্ষান্তরে আরবী হরফে বাংলা ভাষা প্রচলনের এক উদ্ভট পরিকল্পনা তারপর চার বছর কেটে গেলো। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে সবাই একরকম চুপচাপ। ঠিক এমনি সময় একদা জানুয়ারী শেষ ভাগে খাজা নাজিমউদ্দীন সাহেব, ঢাকার জনসভায় উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা করে বসলেন। বারুদে আগুন লাগলো। সাড়ে চার কোটি মানুষের দাবীকে উড়িয়ে দিয়ে, নিজের প্রতিশ্রুতি ও চুক্তি ভঙ্গ করে নাজিমউদ্দীন সাহেব যখন এই ঘোষণা করলেন, তখন সারা পূবর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ বিস্ময়ে স্তম্ভিত ও হতবাক হয়ে পড়লো। চারদিক থেকে তীব্র প্রতিবাদের রোল পাকিস্তানের আকাশেবাতাসে ধ্বনিত হলো। তারপর তিরিশে জানুয়ারী তারিখে ছাত্র ও জনসাধারণের বিরাট মিছিল, জনসভা, একত্রিশ তারিখে মৌলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সবর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন এবং চৌঠা ফেব্রুয়ারী তারিখে শহরে হরতাল পালন ও স্কুল-কলেজ বন্ধ, এসব পর পর হয়ে গেলো। কর্মপরিষদের এক সভাতে একুশে ফেব্রুয়ারী তারিখে দেশব্যাপী হরতাল, শোভাযাত্রা সভাসমিতি করার প্রস্তাব ঘোষণা করা হলো। এগারো, বারো ও তেরো তারিখে কর্মপরিষদের সদস্যদের সাথে আলোচনা করার জন্যে দিন, তারিখ ও স্থান ধার্য করার অনুরোধ জানিয়ে এক চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠির জবাব অবশ্য কোনদিনই পাওয়া যায়নি। হঠাৎ বিশে ফেব্রুয়ারী অপরাহ্নে ঢাকার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট একশ চুয়াল্লিশ ধারা ঘোষণা করে শোভাযাত্রা ও সভাসমিতি বন্ধ করার আদেশ দেন। বিনা মেঘে বজ্রপাত। এর আগে আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে ছাত্র ও জনসাধারণ সৃশুঙ্খল ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে সভা, হরতাল ও মিছিল চালিয়ে গেছে- নিষেধাজ্ঞা জারী করার কোন প্রয়োজন কোনকালেও হয় নি। ছাত্র ও জনসাধারণ এই হঠকারিতায় ভয়ানক বিক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু কর্মপরিষদ সভা আহবান করে তৎক্ষণাৎ ঘোষণাকরেযেশান্তিপূর্ণহরতালপালনকরাহবে, কিন্তু নিষেধাজ্ঞার দরুন সভা ও শোভাযাত্রা বন্ধ রাখা হবে। একুশে তারিখের মৰ্ম্মম্ভদ ও শোকাবহ ঘটনাবলীর পুনরাবৃত্তি করে আপনাদের মনে কষ্ট দিতে চাই না। ঐদিন পর ইতস্তত গমনরত ছাত্রদের উপরে লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, দলে দলে ছাত্রদের গ্রেফতার এবং শেষ পর্যন্ত মেডিকেল ছাত্রাবাসের ভেতর অনধিকার প্রবেশ করে নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলী চালনা ও মৃত্যুর ঘটান এবং অসংখ্য ছাত্র জখম-এ দৃশ্য কারবালার দৃশ্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছে। সভ্য জগতে এর দৃষ্টান্ত বিরল। সারা শহরের প্রত্যেকটি নর-নারীর মনে শোকের ছাড়া পড়ে গেলো। এই নিৰ্ম্মম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রত্যেকটি নাগরিক প্রতিবাদ করে উঠলো। পরদিন সারা শহরে শোকাৰ্ত্ত মিছিল; বিক্ষুব্ধ জনতার তীব্র নিন্দা শহরের প্রতি কোণে ধ্বনিত হলো। এই দিনও পুলিশ গুলী চালিয়ে কতিপয় লোকের মৃত্যু ঘটায় ও অনেকগুলি লোককে জখম করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শহরে কয়দিন “সরকার” ছিল বলে মনে হয় না। একুশে বাইশের ঘটনা যারা দেখেছেন তাঁরাও একথা মনে করেছেন যে কোন সুসভ্য ও গণতান্ত্রিক সরকার তখন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ছিল না, কারণ নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয় ও সুশৃঙ্খল তরুণ সরলপ্রাণ ছাত্রদের উপর কোন সরকার কোন অবস্থায়ই গুলী চালাতে পারে একথা চোখে দেখলেও অনেকে বিশ্বাস করতে রাজী হবেন না। এত বড় অন্যায় কাজ করার ফলে সরকারের আসন টলমল করে উঠলো। চারদিক থেকে মন্ত্রিমণ্ডলীর গদী ছাড়ার দাবী তীব্রভাবে জানানো হতে লাগলো। মন্ত্রী সমর্থক সদস্যরাও পদে ইস্তফা দিতে কৃতসঙ্কল্প হলেন। এটা পরিস্কার বুঝা গেল যে এই মন্ত্রিত্ব আর একদিনও টিকে থাকতে পারছে না। ঠিক এমনি সময়ে পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। মন্ত্রিমণ্ডলী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন- চাকরি রয়ে গেলো। এর আগেই বেগতিক দেখে নুরুল আমিন সাহেব রাষ্ট্রভাষা সম্বন্ধে একটি সোপারেশ প্রস্তাব পরিষদে পাশ করিয়ে নিয়ে জানিয়ে দিলেন যে এর পর আন্দোলনের আর কোন দরকার নেই। বশংবদ পত্রিকাগুলিও সুরে সুর মিলিয়ে গাইতে লাগলো। পরবর্তীকালের ঘটনাবলী পরিষ্কাররূপে প্রমাণ করেছে যে আন্দোলনের কত প্রয়োজন ছিল এবং আছে সরকারের ঘোষণা ও মিষ্টিবুলি কত মারাত্মক ধোঁকাবাজী। সরকার কিন্তু নিৰ্ম্মম হত্যাকাণ্ডের কোন কৈফিয়ৎইদিবারচেষ্টাকরেননি।পক্ষান্তরেমন্ত্রীত্বেরসিংহাসন অবৈধ উপায়ে নিরাপদ করতে দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করলেন। নানা প্রকারের কুয়াশার জাল সৃষ্টি থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে বানচাল করে দেওয়ার জন্য নিতান্ত জঘন্য মিথ্যা প্রচার আরম্ভ করে দিলেন। প্রথম থেকে বাঙালী-অবাঙালী বিরোধ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাও চলছিল, কিন্তু সে চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। গোটা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কমু্যনিষ্ট রাষ্ট্রদোহী ও বিদেশী দালালদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল এবং তারাই ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিয়েছে, রাজনৈতিক সুবিধাবাদীরা এর সাথে হাত মিলিয়ে সহায়তা করেছে, ফলে গোটা রাষ্ট্রটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো- এই সব প্রচার করে লক্ষ লক্ষ ইস্তাহার হাওয়াই জাহাজে দেশময় ছড়িয়ে সরকার দেশে একটা ভীষণ আতঙ্কের সৃষ্টি করে তোলেন। মুসলিম লীগও সময় বুঝে ঠিক ঐ মৰ্ম্মে প্রস্তাব পাশ করে দেশবাসীকে সাবধান করে দেন, যেন কেউ এসব আন্দোলনে যোগ না দেন। সঙ্গে সঙ্গে ধরপাকড় আরম্ভ হয়ে যায়। ছাত্র, যুব কর্মী, পরিষদের সদস্য, বিরোধী দলের নেতা ও কর্মী, এবং কতিপয় অধ্যাপককে জেলে ঢোকানো হলো। সলিমুল্লা মুসলিম হলে হামলা করে অনেকগুলি ছেলেকে ধরে আনা হলো। শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যে ছাত্রবন্ধুগণ মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলে যে স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তুলেছিলেন সরকার তা নির্মমভাবে ধূলিসাৎ করেন।ববর্বরতার এমন নজির কোথায় ও মিলে না।

সারা দেশের লোক আতঙ্কিত হয়ে উঠলো। মুখ ফুটে কথা কইবার জো নেই। বশংবদ সংবাদপত্রগুলি আন্দোলনের কথা, কৰ্ম্ম পরিষদের বিবৃতি ইত্যাদি সব ছাপানো বন্ধ করে দিলো। তাদেরও নাকি টুটি টিপে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু নাজিমউদ্দীন সাহেবের শ্যালক খাজা নুরুদ্দীন সাহেবের মনিং নিউজ শুরু থেকেই জঘন্য প্রচারণা শুরু করে। দেশের যুবক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়, শহরের সর্দার সবাইকে রাষ্ট্রদ্রোহী, গুণ্ডা ইত্যাদি আখ্যা দিনের পর দিন দিয়ে যেতে লাগলো-এখানো দিচ্ছে। সারা দেশ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও সরকার এর কোন প্রতিকার করেন নি। পক্ষান্তরে সরকার মর্নিং নিউজের গল্পই বিশ্বাস করে তদনুযায়ী দমন নীতি চালিয়ে যান। এই পত্রিকাটিই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ, অধ্যাপক, ছাত্র সবাইকে ষড়যন্ত্রকারী, রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অতি জঘন্য ভাষায় গালি দেয়। সরকারও তা সমর্থন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরুদ্ধে এরূপ মিথ্যা অভিযোগের নজির ইতিহাসে আর নেই। কোথায় কোন বিদেশী পত্রিকা কি বলেছে, কোথায় কোন সিপাহীকে কে বা কাহারা নিহত করেছে, তার বিচার না করে, দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের উপর। একথাও বলা হয়েছে যে নারায়ণগঞ্জেও জয়হিন্দ’ ও যুক্ত বাংলার ধ্বনিও কেউ কেউ করেছিল। আজ কিন্তু এ কথা দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে এই সব অভিযোগ, কটাক্ষ, দৃষ্টান্ত, মিথ্যা ও বানোয়াট এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে গলাটিপে মারার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। এতো প্রচার সত্ত্বেও কয়েকটি সরকারী ধামাধরা কর্মচারী আর মুসলিম লীগের কোন কোন সভ্য ছাড়া পূবর্ব পাকিস্তানের কোন ব্যক্তিই এসব কথা বিশ্বাস করতে পারেনি। গণপরিষদের দু’একজন সদস্য পরিষ্কার বলেছেন যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে সরকার ও মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। যারা বাস্তবিক পক্ষে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চালিয়ে গেল তারা কোনদিন কমু্যনিষ্ট, রাষ্ট্রদ্রোহী বা বিদেশী দালালদের অস্তিত্ব ভিতরে বাইরে কোথায়ও খুঁজে পায়নি। সরকারও আজ পর্যন্ত একটি রাষ্ট্রদ্রোহীকে গ্রেফতার করে তাদের বহু উচ্চারিত ভাষণের পোষকতা করতে পারেননি। বিদেশী সাহয্যের কোন দলিল বা প্রমাণ আজ পর্যন্ত লোকসমক্ষে ধরতে পারেননি। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তি পাহারারত কোন সিপাহীর হত্যার ব্যাপারে জড়িত হতে পারে এ কথা কোন বুদ্ধি ও বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি বিশ্বাস করতে পারে না। পাকিস্তানের বুকে দাঁড়িয়ে “জয় হিন্দ” বা “যুক্ত বাংলা” ধ্বনি উচ্চারণ করার মত দুঃসাহস কারো হতে পারে এ কথা কোন পাগলও বিশ্বাস করতে রাজী হবে না। অথচ নুরুল আমিন সাহেব ও তাঁর মুরবিব নাজিমউদদীন সাহেব অম্লান বদনে তা শুধু বিশ্বাসই করেননি, পরিষদ ভবনে ঐ মৰ্ম্মে বিবৃতিও দিয়েছেন। হলফ করে বলা যেতে পারে যে, তাঁরাও এ কথা অন্তরে বিশ্বাস করেন না কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনগণের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য তাঁরা নিজেরাই এ সমস্ত গল্প সৃষ্টি করে বারবার প্রচার করছেন- এটা তাঁদের স্বভাব। তাঁরা যেন বোঝাতে চান যে, গোটা পাকিস্তানটাই মূর্থের আবাসভূমি আর তাঁরা এবং তাঁদের কুক্ষিগত মুসলিম লীগ সমস্ত জ্ঞানের একমাত্র অধিকারী। নিৰ্ম্মম দমন নীতির মুখেও আজ পূবর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি নর-নারীর মুখে এই ধ্বনিই স্পদিত হচ্ছে যে, মুসলিম লীগ ও তার সরকার কোনদিনই জনগণের কোন দাবী মেটাতে পারেনি ও পারবে না। চিরদিন যারা মিথ্যার বেসাতি করে এসেছে তাদের কাছে জনগণ কিছুই আশা করতে পারে না-করেও না। সেদিন পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষার দরদীগণ যে নির্লজ্জ প্রহসনের পালা সাঙ্গ করলেন তার কালিমা ইতিহাসের পাতা হতে কোনদিনই মুছে যাবে না। সমগ্র জাতির ইতিহাস কলঙ্কিত হয়ে রইলো। যাঁরা বাং ভাষাকে ভালোবাসার ভান করে পরিষদের সোপারিশ প্রস্তাব পাশ করে জনগণকে আন্দোলন হতে বিরত থাকার কালের জন্য চাপা রইলো। সমস্যাটি জরুরী নয়- পূবর্ব বাংলার তরুণ-প্রাণ মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আত্মাহুতি দিয়েও সমস্যাটিকে জরুরী প্রমাণ করতে সক্ষম হয়নি। ইসলাম ও পাকিস্তানের নামে মুসলিম সংহতির নামে আমাদের ভাগ্যনিয়ন্তারা সমস্যার মোকাবেলা না করে ধামাচাপা দেবার সহজ পথই বেছে নিলেন।

পূর্ব বাংলার প্রতিটি নাগরিক বুঝতে পারলো এ সমস্যার সমাধান তারা কখনও করবে না। এদিকে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা কেউ কেউ দেশে ফিরে এসে এর কৈফিয়ৎ দিতেগিয়েনতুননতুনভাঁওতাসৃষ্টিকরলেন; জনসাধারণের ন্যায্য ও পবিত্র দাবী দাবিয়ে রাখার অপরাধের সাফাই গাইতে হবে ত! পূবর্ব পাকিস্তানের জনগণ আজ জাগ্রত। বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়ে তারা জগতকে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমগ্র জাতির ন্যায্য দাবী কোন স্বৈরাচারী সরকারই কোন হিংস্র উপায় অবলম্বনে দমিয়ে রাখতে পারে না। জীবন দিয়ে যে জাতি তার দাবীর সত্যতা ও পবিত্রতা প্রমাণ করেছে সে দাবীকে অগ্রাহ্য করবার সাধ্যি কারো নেই। বন্ধুগণ, মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারের কার্যাবলী আজ আয়নার মত আপনাদের চোখের সামনে-তার বিশ্লেষণ বা তফছিরের কোন প্রয়োজন নেই-বন্ধুবেশে এরা গত পাঁচ বছরে আমাদের জাতীয় জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে-প্রত্যেকটি সমস্যাকে ধামাচাপা দেবার জন্য এরা চিরদিন চেষ্টা করে এসেছে। এত বড় একটা স্বতঃস্ফূৰ্ত্ত আন্দোলনের ভিতরও ভাঙ্গন ধরাবার জন্য এরা নানা অলীক ও মিথ্যা অভিযোগ সৃষ্টি করেছে, দালাল লেলিয়ে দিয়েছে, মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সরকার ও মুসলীম লীগ জানে যে, পূবর্ব পাকিস্তানের জনগণ সমবেত কণ্ঠে তাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে, তাই কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্যে তারা জনগণের বুকে দিয়েছে মারণ কামড়। যে উপায়ে হোক এ আন্দোলনকে দাবীয়ে দিতে পারলে-কিংবা অন্ততঃ ভাঙ্গন ধরাতে পারলেও তাদের খানিকটা লাভ। সেই লাভের আশায় তারা নতুন নতুন ফন্দী আবিষ্কার করে যাচ্ছেন। এদের অনেককে আমরা দেখেছি আন্দোলনের পুরোভাগে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনকে বিপথগামী করার চেষ্টাও করেছেন। তা’ না পেরে শেষে পাততাড়ি গুটিয়ে উল্টা সুর গাইতে শুরু করেছেন। সবর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ দাবী জানিয়েছিল যে, সরকারের কার্য্যাবলী তদন্ত করার জন্য সরকারী ও বেসরকারী সদস্য দ্বারা গঠিত প্রকাশ্য তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হোক। সে দাবী উপেক্ষা করে মাত্র একুশে তারিখের পুলিশের গুলীবর্ষণ আইনসঙ্গত হয়েছিল কিনা- এ ব্যাপারে তদন্ত করার জন্যে একটি গোপন তদন্ত কমিশন নিযুক্ত করা হয়েছে। বাইশে তারিখের ঘটনাবলী সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। একশ’ চুয়াল্লি ধারা জারি করার কোন আইনসঙ্গত কারণ ছিল কিনা সে সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। অথচ এই নিষেধাজ্ঞাই সমস্ত দুর্ঘটনার জন্যে দায়ী। পূবর্ব পাকিস্তানের যেসব জায়গায় নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি সেখানে কোন গোলমালই ঘটেনি। সুতরাং কমিশন নিযুক্তির ব্যাপারেও সরকার যে জনগণকে ধোঁকা দিয়েছেন-তা স্পষ্ট বোঝা যায়। জনসাধারণ ও ছাত্র সমাজের দিক দিয়ে তদন্তের কোন মূল্যই নেই। তাই রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ এতে যোগদান করেনি। কথা এখন মুসলিম লীগ ও লীগ সরকারকে নিয়ে নয়, কথা হচ্ছে এখন আমাদের নিয়ে। সরকার প্রচার করছে যে, মুসলিম লীগ ও সরকারের রোপিত বিষবৃক্ষ ফল দিতে আরম্ভ করেছে- জনসাধারণ দমে গিয়েছে, ছাত্র সমাজও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষার দাবী মেটাবার ভার মুসলিম লীগ ও সরকার গ্রহণ করেছেকথাটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এত বড় একটা স্বতঃস্ফূৰ্ত্ত আন্দোলন কতকগুলি মিথ্যা ভাঁওতার চাপে দমে যাবে-যে জাতি জীবন দিতে শিখেছে সে জাতি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে-এরূপ কল্পনা করা অন্যায়। সাময়িক প্রতিক্রিয়া বিশ্বাসপ্রবণ সরল মনে কিছুটা কুয়াশা সৃষ্টি করতে পারে কিন্তু তার অন্তরের অন্তঃস্তলে বাসা বাঁধতে পারে না। প্রয়োজন হলে সে আবার দাঁড়িয়ে উঠে, বুক ফুলিয়ে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার স্বরূপ প্রকাশ করতে পারে। বন্ধুগণ, জানি আপনাদের উপরও সরকারের আক্রোশ কম নয়-আপনারাও কম নির্যাতন ভোগ করেননিকিন্তু তা সত্ত্বেও যে আজ এখানে সমবেত হয়েছেন এতেই স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে সরকারের বুজরগী ব্যর্থ ও বিফল হয়ে গিয়েছে। তারাই যে পাকিস্তান ও ইসলামের একমাত্র রক্ষক আর পূবর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের মনে পাকিস্তান ও ইসলামের জন্যে বিন্দুমাত্র দরদ নেই- এ কথা বলে যে দুর্বিষহ অপমানের ভার আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়- তার প্রতিবাদের দিন এসেছে। আপনারা প্রমাণ করে দিন- যারা ইসলাম ও পাকিস্তানের একমাত্র জিম্মাদার বলে দাবী করে- তরা ভণ্ড। পাকিস্তানের অস্তিত্ব তাদের অনুগ্রহ-নিগ্রহের উপর নির্ভর করে নাপাকিস্তান বেঁচে থাকবে, আর তার কোটি কোটি বাসিন্দা নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে- তাদের অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, শক্তি ও সামর্থ্যের জোরে। রাষ্ট্রভাষা সমস্যাই আমাদের একমাত্র সমস্যা নয়। বহু ছোট-বড় সমস্যা আমাদের জীবনে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে- তারও সমাধানের প্রয়োজন। সমগ্র জাতিকে সংঘবদ্ধ করে এসব সমস্যার সমাধান আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে, কারণ রাষ্ট্র আমাদের। কিন্তু তার জন্যে চাই শৃঙ্খলা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতা। আপনারা শক্তি অর্জন করুন, প্রতিটি মানুষের প্রাণে দেশাত্মবোধ, জীবন ধারণের প্রয়োজন বোধ জাগিয়ে তুলুন। ঘরে ঘরে একই আওয়াজ তুলুন- “আমাদের দাবী মানতে হবে।” আমাদের সংগ্রাম এক দিনের নয়। যে প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব বৰ্ত্তমানে আমাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে তারা সহজে কাবু হবার নয়-তাড়াহুড়া করে হৈচৈ করে বা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে আমাদের কাজ উদ্ধার হবে না দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের নীতি অবলম্বন করে ধীরে ধীরে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে হবে। হট্টগোল করে যেন এর গুরুত্ব আমরা নষ্ট না করি এদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ধীর বিচারবুদ্ধির একান্ত প্রয়োজন। আপনারা সারা পূবর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। সারা দেশ আপনাদের দিকে চেয়ে আছে। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা আপনারা নির্ধারণ করুন।প্রত্যেক শহরে, মহকুমায়, থানায় গ্রামে কর্মপরিষদ গঠন করে তুলুন। -এই হবে আপনাদের আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়। আর আওয়াজ তুলুন : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বন্দীদের মুক্তি চাই।”

পাকিস্তান জিন্দাবাদ