3

বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়াঃ বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর প্রকাশিত একটি পুস্তিকা

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
বাংলাদেশের ঘটনাবলীর উপর বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়াঃ বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দফতর প্রকাশিত একটি পুস্তিকা বাংলাদেশ সরকার …১৯৭১

 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

মুখবন্ধ

মানব সভ্যতার সবচেয়ে জঘন্যতম ঘটনাটি বাংলাদেশে সংঘটিত হয়। পাকিস্তানী আর্মিরা বাঙ্গালীদের ধ্বংস করার সব পরিকল্পনা নিয়ে আবির্ভুত হয়।। তারা ৭৫ মিলিয়ন শান্তিপ্রিয় নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পরে।

সারা বিশ্ব মানব সভ্যতার উপর এই বর্বর নির্যাতনের নিশ্চুপ সাক্ষী ছিল। এত কিছুর মাঝেও কিছু নেতা ও বিবেকবান সাংবাদিক এই অত্যাচারের প্রতিবাদ করে বাঙ্গালীদের পাশে এসে দাঁড়ায় । তারা ইয়াহিয়া খানের বর্বরতার কথা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে।

এভাবে অবহেলিত ও চাপা থাকা ঘটনা সবার সামনে আসে।

ঘটনাগুলো এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যাতে বাঙ্গালীদের উপর করা অত্যাচার ও তাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ফুটে উঠে। এখানে আমাদের নিজস্ব কোনো মতামত নেই, শুধু প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।

আমরা বিশ্ব বাসি কে এটা পড়ার আহবান জানাই।

জয় বাংলা।

 

বহিঃপ্রচার বিভাগ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

 

স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতার পথে সাংবিধানিক আন্দোলন

 

অংশ নেবার অপরাধে শত শত হাজার বাঙ্গালিদের হত্যা করা হয়েছিল। খুন, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ আর ধর্ষণ ছিল সেদিনের নির্দেশ। কেন? কারণ তারা স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। তাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দেশদ্রোহিতারর অপরাধে বিচারাধীন ছিলেন। কারণ তিনি নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন , যেখানে গন্তন্ত্রের সাংঘর্শিক কিছু  ছিল না এবং সর্বোপরি,তিনি স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে আপোষহীন ছিলেন, যার জন্য বাঙ্গালিরা তাকে ভোট দিয়েছিলেন। আওয়ামীলীগ গণতন্ত্র এবং সংবিধানের নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী একটা গণতান্ত্রিক দল ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের প্রশ্নে একনিষ্ঠ ছিলেন। গণতন্ত্র এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে তার মনে অটল বিশ্বাস ছিল। তিনি অহিংস উপায়ে জনগণের চাহিদা নিয়ে আওয়াজ তুলেছিলেন। ‘দ্যা নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকা ২৮ মার্চ লিখে, “তিন রাত আগে সরকারি সৈন্য দ্বারা সাধারণ মানুষের উপর অকস্মাৎ আক্রমণের পর যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে সহিংসরূপে ফেটে পড়েছে।” এই একই লাইনের সাথে ৪ এপ্রিল ‘বাল্টিমোর সান’ লিখে “পশ্চিম পাকিস্তান প্রয়োজনে তাদের সর্বশেষ সৈন্য জনবহুল পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানোর সব ইঙ্গিত দিয়েছে, যার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যথাসম্ভব কারণ একটাই, বিগত ডিসেম্বরের ভোটের ফলাফল। ইয়াহিয়া খানকে উল্লেখ করে ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ ৬ এপ্রিল তার সম্পাদকীয় তে লিখে “তিনি তার সেনাবাহিনী ব্যবহার করে যা করেছেন এবং করছেন তা পূর্ব পাকিস্তান এবং তাদের নেতাকে দমিয়ে রাখার জন্য। কোন দৃষ্টিকোণ থেকেই এটা সন্ধিস্থাপনে ধস নামার কারণে নয়। রাষ্ট্রপতি ভোটের সময়েই শেখ মুজিবের ক্ষমতা অনুধাবন করতে পেরে তাকে আর চাননি। তাই রাষ্ট্রপতি বন্দুক তুলে নিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের দরিদ্র জনগণ যারা ভোট দেয়ার শাস্তি পাচ্ছিলো, সেই ভোট রাষ্ট্রপতিকে চিন্তিত করে তুলেছিল। আর্মি পাঠিয়ে তিনি শুধু গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতিই উদাসীনতা দেখাননি, বরং নিজেকে বেপরোয়া এবং অবিবেচক শাসক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছিল সুপরিকল্পিত কাজ।” ‘দ্যা গার্ডিয়ান’ ১৪ এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে লিখে “বাংলাদেশের বিষয়াবলী দিল্লী এবং রাউয়াল পিন্ডির মধ্যকার অন্তহীন ঝামেলার ফল না। যখন একটা সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পর সেনাবাহিনী সেটা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে নি তখনই এর উত্থান হয়। শেখ মুজিব কখনোই কোনভাবেই নিজে থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেননি। তিনি মূলত বেশি কিছু চান নি শুধু আইনগতভাবে লড়াই করে ভোটে জিতে যা পেয়েছেন তা ছাড়া।”

বর্তমান পরিস্থিতির পটভূমি এবং পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক শোষণ উল্লেখ করে ১৮ এপ্রিল ‘দ্যা সানডে টাইমস’ লিখে “শেখ মুজিবের আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক পরিকল্পনা সিংহভাগ পূর্ব পাকিস্তানিদের কাছে সাম্প্রতিক নির্বাচনে অনুমোদিত হয়েছিল, যা আওয়াজ তুলেছিল কেন্দ্রীয় রাজ্য সরকারের হস্তান্তর নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক নীতিমালার বৈষম্যের সংশোধন বিষয়ে। ইয়াহিয়া খান সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল নিয়ন্ত্রণহীন ত্রাসযুক্ত শাসন যার মাত্রা কেবল ধীরে ধীরে জ্ঞাত হচ্ছিল।

 

সুদানের দৈনিক ‘আল সাহাফা’ও এই বিতর্ক এড়িয়ে গেল যে পূর্ব বাংলার সংগ্রাম একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। তারা লিখেছিল “এই বিস্ফোরিত অবস্থার জন্য দায়ী জেনারেল ইয়াহিয়া খান। মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত প্রতিনিধি।……….. মুজিবুর রহমানের আদর্শ সম্মানযোগ্য এবং তিনি সত্যিকার অর্থেই গণতন্ত্রের নিদর্শন।” সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবে ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট বক্তব্যে বলেছিলেন “আমি আমার সহকর্মীদের মনে করিয়ে দিতে চাই যে, সন্ধি পূর্ববর্তী ২৫ মার্চের আকস্মিক মিলিটারি আক্রমণ এর কথা। পূর্ব পাকিস্তানের চাহিদা স্বাধীনতা ছিল না, শুধু স্বায়ত্তশাসন এবং নিজেদের বিষয়ে স্ব-নিয়ম; যেমন কর্মপন্থা আর আধাসামরিক বাহিনী, ব্যবসা বাণিজ্য, কর এবং অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এবং এরকম আর কিছু বিষয়।” ১৮মে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর প্র‍্যাঙ্ক চার্চ তার বয়ানে আওয়ামীলীগ সম্পর্কে নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে উল্লেখ করে বলেন “এই বাঙ্গালি রাজনৈতিক দলটি অভূতপূর্ব অনুমোদন পেয়েছে; পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯ এর মধ্যে ১৬৭ টি আসন আর জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনকে সমর্থন করে।” ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তান আর্মি বাঙ্গালিদের হাতে ক্ষমতা দিতে অনিচ্ছুক ছিল।

২১ জুন ‘কেন্সিংটন পোস্ট’ এ জর্জ ক্লার্ক লেখেন “৫ মাস থেকে এখন অব্দি বাংলাদেশ যে বিশাল দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা শুধুমাত্র পাকিস্তান সামরিক সরকার কর্তৃক একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ফল। এটা যেন স্যার ম্যালবি এবং কনজারভেটিভ বোরঘ কাউন্সিলের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে নিরাপত্তারক্ষী ডেকেছে।” ১৪ জুন, ১৯৭১ গার্ডিয়ান তাদের সম্পাদকীয় ত্র পাকিস্তান সরকার এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বৈধতা নিয়ে লেখে “এবং যদিও পাকিস্তান সরকার নির্বাচনের রায় উল্টে দেয় তবুও দখল নির্বাচনের হাতেই থাকবে।” ‘দ্যা ডেইলি মিরর,লন্ডন’ এর আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা জন পিলগার ১৬ জুন, ১৯৭১ লিখেন “বাঙ্গালিদের অপসৃত বা বিদ্রোহী হতে হবে না। তারা পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং দেশের প্রথম নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেখ মুজিবুরের আওয়ামীলীগকে ভোট দিয়ে অভূতপূর্বভাবে ১৬৯টির মধ্যে ১৬৭টি আসন দখল করে বাঙ্গালিদের জন্য জাতীয় পরিষদে জায়গা করে নিয়েছে।শেখ মুজিবুরের স্বল্পমেয়াদী সরকার অনেকটা গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মি. হেথের সরকারের মতো।” পিলগার আরো লেখেন “বাংলাদেশের অভ্যুত্থান তখনই হয়েছিল যখন ঢাকা ত্রাসের শাসনে আক্রান্ত হয়েছিল।” লেবার এম. পি. মি. টেড লিডবিটার তার এক চিঠিতে পাকিস্তানি হাইকমিশনার সালমান আলীকে বলেন “প্রত্যেকটা রিপোর্ট, প্রত্যেকটা টেলিভিশন এবং বাংলাদেশ ইস্যুতে প্রত্যেকটা সংস্করণ তোমার প্রজ্ঞাপনের সাথে সাংঘর্ষিক।…….যে রক্তের দাগ প্রত্যেকে তোমাদের হাতে দেখতে পাচ্ছে তা কোন কূটনৈতিক চালই তোমার নেতাদের নির্বুদ্ধিতা, তোমার নীতিমালার দায়িত্বজ্ঞানহীনতার সমালোচনা থেকে আমাকে দূরে রাখতে পারবে না এবং তাদের সাহায্য প্রয়োজন যারা শুধু গণতন্ত্র ছাড়া আর কিছুই চায় না।”

 

বেইরুট পত্রিকা আল শাব-এ প্রকাশিত, “বস্তুত পুর্ব পাকিস্তান অপসারনের কাছে মাথা নত করেনি যতক্ষন না এটা প্রমানিত হয়েছে যে, দেশের শাসন ব্যবস্থা জনগণের ইচ্ছা নয় বরং ১০০০ মাইল দূরে অবস্থান করা একটি দাম্ভিক গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করে।এরকম একটি দেশে বসবাসের অনুমোদন কে দেবে? পাকিস্থান একটি কৃত্রিম স্বত্তা এবং যেকোন কৃত্রিম জিনিস বিলুপ্ত হবেই।”

 

২৩ আগস্ট, টাইমস ম্যাগাজিনে লেখা হয়, “যদিও পুর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার জন্য মুজিবকে অভিযুক্ত করা হয়, প্রকৃত পক্ষে তিনি পাকিস্তানের পুর্ণ বিভক্তি চাননি এবং ততক্ষন পর্যন্ত স্বাধীনতা ঘোষনা করেননি যতক্ষন না………………… রক্তগঙ্গা শুরু হয়।”

 

ইংল্যান্ডের হাউস অফ লর্ড-এর লর্ড ফেন্নের ব্রকওয়ে, এক বিবৃতিতে বলেন, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিরোশিমায় বোমা নিক্ষেপের পর এটাই সবচেয়ে বড় দুর্দশাপুর্ণ বিপর্যয়। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিটলারের পর এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে নির্মম অস্বীকার।

 

গণতন্ত্রকে অন্তর্ঘাত করার ষড়যন্ত্র

 

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান, জনাব জুফিকার আলী ভুট্টো এই রাজনৈতিক নাটকে সবচেয়ে সন্দেহজনক ভুমিকা পালন করেন। তার অনুরোধে এবং আওয়ামী লীগয়ের একটি সময়পুর্ব সমাবেশের অনুরোধ উপেক্ষা করে জেনারেল ইয়াহিয়া ৩ মার্চ সমাবেশের ঘোষনা দেন, এবারও জনাব ভুট্টোই সর্বপ্রথম সমাবেশ বয়কট করেন। শুধু তাই না, তিনি প্রকাশ্যে পশ্চিম পকিস্তানের অন্য সদস্যসের সমাবেশে উপস্থিত থাকার ব্যপারে ভয় দেখান।তিনি এই ইস্যুতে একটি রক্তগঙ্গার হুমকি দেন। সমাবেশ ঘোষনার প্রতিবাদে তিনি সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে একটি সাধারন ধর্মঘটের ডাক দেন, তিনি   খায়বার থেকে করাচি পর্যন্ত একটি হরতাল দাওয়ার হুমকি দেন, যেখানে জনাব ভুট্টো জাতীয় পরিষদের একটি সংখ্যা লঘু দলের নেতা ছিলেন এবং শুধুমাত্র পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে সংখ্যাগরিষ্ট আসন নিশ্চিত করেছেন। একদিকে তিনি ক্ষমতা, গণতন্ত্র এবং সাংবিধানিক সরকারের দ্রুত হস্তান্তর দাবি করেন অন্যদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের বিরোধিতা করেন।

 

যখন নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হল, সামন্ততান্ত্রিক নেতাদের দ্বারা সমর্থিত সেনাবাহিনী এবং জনাব ভুট্টো উভয়ের এবং গণতন্ত্রের সকল প্রত্যাশাকে অন্তর্ঘাত করার পশ্চিম পাকিস্তানি মূল উদ্দেশ্য উন্মোচিত হয়।জনাব হেনরি ব্র্যাডসের ২৯ এপ্রিল, ওয়াশিংটনের ইভিনিং স্টার-এ লিখেছেন “যখন নির্বাচনের ফল পাওয়া গেল, ভুট্টো পুর্ব পাকিস্তানের তাদের ইচ্ছানুযায়ী শাসনতন্ত্র পাওয়ার অধিকারকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা শুরু করেন।ভুট্টো, একজন সামন্ততান্ত্রিক ভূপতি এবং উজ্জ্বল কিন্তু সুবিধাবাদী কর্মজীবন সম্পন্ন সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী, দরিদ্রদের কাছে সমাজতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে পশ্চিমে জয়ী হন।যদিও রহমানের বিরুদ্ধে তার প্রতিবন্ধক রনকৌশল গরীবদের থেকে পশ্চিমা অভিজাত শ্রেনির স্বার্থই বেশি রক্ষা করবে।

 

২০ জুলাই, লন্ডন, টাইমস-এ লেখা হয়, জনাব ভুট্টোর যুক্তি ছিল যে, সমাবেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (যেখানে এটি 167 টি আসন লাভ করে) লাভের ভিত্তিতেও আওয়ামী লীগ যৌক্তিকভাবে সমগ্র পাকিস্তানের পদ নির্দেশনা আশা করতে পারে না, যখন এটি শুধুমাত্র একার্ধের প্রতিনিধিত্ব করে।এটি একটি খুবই দুর্বল যুক্তি ছিল। কিন্তু ৩ মার্চের পরিকল্পিত নির্বাচক পরিষদের মিটিং স্থগিত করার জন্য রাষ্ট্রপতিকে অজুহাত দাওয়ার মত যথেষ্ট আইনি ও সাংবিধানিক সত্ত্ব এর ছিল।

 

যদিও তারা নির্বাচনের অনুমতি দিয়েছে, জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অভিপ্রায় কখনই সামরিক সরকারের ছিল না। তাদের পরিকল্পনা ছিল যে, একবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিভিন্ন

দলের মধ্যে আসন গুলো ভাগ হয়ে যাবে, দেশে একটা রাজনৈতিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে এবং তারা তাদের শাসন চিরস্থায়ী করার জন্য রাজনীতিবিদদের ছোট করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচনের ফল তাদের পরিকল্পনা ধুলিস্বাৎ করে দেয়। ইয়াহিয়া খাঁন শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার একটি গোপন উদ্দেশ্য ছিল।

একজন পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা এবং পাকিস্তানের জাতীয় আওয়ামী পার্টির সভাপতি, খাঁন আব্দুল ওয়ালী খাঁন আফগান পত্রিকা নিউ ওয়েভকে দাওয়া এক সাক্ষাৎকারে(দি স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়ার ১৯ আগস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী) বলেন, “রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খাঁন সেনাবাহিনীর খবর বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়েছিলেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সফলকাম হবে না। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, কাইয়ুম মুসলিম লীগের ৭০টি আসনে জয়ী হওয়ার কথা, দৌলতানা ৪০টি, ভুট্টো ২৫টি, জাতীয় আওয়ামী পার্টি ৩০টি এবং মুজিবের আওয়ামী লীগ শুধু মাত্র ৮০টি আসনে জেতার কথা। এই তথ্যের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জনগণকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে সম্মত হয়েছেন যে, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। এটা ছিল একটা জুয়া খেলা যা ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু সামরিক জান্তা ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করে। ”

৬ জুলাই, দি গার্ডিয়ান, লন্ডন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোভাব, বর্ণনা করে, “তিনটি বাক্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রকৃত মনোভাব। নির্মম, মানুষের জীবনের ব্যাপারে উদাসীন, নির্বিচারে হত্যাঃ এবং, মানসিকভাবে অস্বাভাবিক রকমের হিংস্র।”

নিউসউইক ম্যাগাজিন “বাংলাঃ একটি জাতির হত্যা” শিরোনামে ২রা আগস্ট, ১৯৭১ এ একটি কভার পেইজ স্টোরিতে লেখে, “হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে যে, বাংলার সময় এসেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও পুর্বের স্বায়ত্ত শাসনের জন্য মুজিবের অবস্থান পাঞ্জাব নেতাদের সহ্যের চেয়ে বড় হুমকিতে পরিনত হল।মুজিবের সাথে দ্বিতীয়বার লড়তে নারাজ পশ্চিম পাকিস্তানের জনপ্রিয় বামপন্থি রাজনীতিবি, জুলফিকার আলী ভুট্টো নতুন সংসদে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এবং শেষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আচমকা পরিষদের উদ্বোধনী অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন।

২রা আগস্ট, ১৯৭১ এ প্রকাশিত একটি কভার স্টোরিতে টাইম ম্যাগাজিন বলেছিল, “নির্বাচনের বিজয় বুঝায় যে, মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পুরো পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রি হবেন।

এটা এমন একটা বিষয় যা ইয়াহিয়া আগে থেকে আঁচ করতে পারেননি। তিনি এবং তার সহকর্মী জেনারেলগণ আশা করেছিলেন যে, মুজিব পুর্ব পাকিস্তানের ৬০% এর বেশি আসন পাবে না, এবং এই ক্ষুদ্র পুর্ব পাকিস্তানী দলটি পশ্চিম পাকিস্তানি দল গুলর সাথে জোট গঠন করবে, প্রকৃত ক্ষমতা ইসলামাবাদেই থাকবে।মুজিব কিছু কারচুপির আশংকা করছিলেনঃ “যদি নির্বাচন হতাশাব্যঞ্জক হয়,” তিনি একটি বিবৃতিতে ঘোষনা করেছিলেন যা ভয়াবহ ভবিষ্যতের আভাস দেয়।পুর্ব পাকিস্তানের জনগণ সেই সকল লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের কাছে ঋনী যারা যদি দরকার হয়, আরো লক্ষ্য লক্ষ্য মানুষের আত্মদান দিতে ঘুর্নিঝড়ে মারা গেছে, যাতে আমরা একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচতে পারি।”

 

একটি পূর্বকল্পিত পরিকল্পনা “. শক্তি। হস্তান্তর করা হবে নাঃ

 

ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন কখনই জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায়নি, এটা আরো স্পষ্ট হল এই ঘটনা থেকে যে তারা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের জনগণের উপর হামলার পতিকল্পনা করছে। ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে, নির্বাচনের পরে যখন আলোচনা চলছিল, সেনাবাহিনী সেই কয় মাসে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কিভাবে দেশের নতুন গণতান্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য আঘাত হানা যায় তার বিশদ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

 

২৮মার্চ সিডনি স্কেনবার্গ নিউ ইয়র্ক টাইমস এ লিখেছেন, “কিন্ত যেসব ছোট ছোট তথ্য উপাত্ত আলোতে এসেছে সেগুলো দ্বারা এটিই প্রতীয়মান হয় যে পশ্চিমের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী শেখ মুজিবকে কখনই পূর্ব পাকিস্তানে এককভাবে স্বায়ত্ত্বশাসনে জয়ী হতে দিতে চায়নি।” একই দিনে তিনি লিখেন, “ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রতিদিন প্রচুর সৈন্যদল প্রবেশ করছিল। অনেক বাঙালী বিশ্বাস করতে শুরু করলো যে, আলাপ-আলোচনা ভেবেচিন্তেই দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে যেন পশ্চিম পাকিস্তান সরকার পূর্ব অংশে ভারী  শক্তিবৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত সময় হাতে পায়।”

দ্য বাল্টিমোর সান এর একজন লেখক ৩০মার্চ “পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার পরিকল্পিত আক্রমণ” শীর্ষক খবরে বলেন, “কিন্ত সেই পরিস্থিতি(সেই ক্ষুদ্র চাল যখন ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে সংলাপ প্রত্যাখ্যান করে) অতিমাত্রায় সরল ছিল না, এটি ছিল খুবই কপট। এটি সংলাপের পুরো উদ্দেশ্যকে একটি বিলম্বিত প্রক্রিয়া হিসেবে দেখাবে যার মাঝে তারা(পাকিস্তান আর্মি জেনারেলেরা) পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরও সৈন্যদল উড়িয়ে নিয়ে আসতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “এই মন্তব্যটিই প্রথম সংকেত নয় যে সংলাপগুলো ছিল একটি বিলম্বিত প্রক্রিয়া। করাচী থেকে ঢাকা আগত একজন ভ্রমণকারী অগ্নিকাণ্ডের এক সপ্তাহ আগেই সাংবাদিকদের চমকে দিয়েছেন এটি বলে যে, তার একজন বিশ্বস্ত জেনারেল তাকে বলেছেন যে, সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা হলো বাঙালী নেতৃবৃন্দদের এটি বিশ্বাস করানো যে সংলাপ সফল হতে পারে, আর তারপর তারা বিনা সতর্কবার্তায় ঝাপিয়ে পড়বে।”  তিনি আরও যোগ করেন, “ঘটনাটিকে শুধুমাত্র একটি অরক্ষিত জাতির উপর সতর্কভাবে সমন্বিত পূর্বপরিকল্পিত একটি আক্রমণ হিসেবেই বর্ণনা করা যায় যে আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়া যে আন্দোলনের কৌশল ছিল অহিংস ও অসহযোগ… জেনারেল টিক্কার পূর্বগামী ব্যক্তি, যে আন্দোলনটি ভাল্ভাবে বুঝতে পারা জন্য বাঙালীদের মাঝে পরিচিত ছিল, ঢাকা ত্যাগ করেন এবং পূর্ব পাকিস্তান চলে যান কোনো প্রকাশ্য কৈফিয়ত ছাড়াই। যেসব বাঙালী তাকে চিনতেন তারা বলেন, মার্চের এক তারিখ প্রাথমিক পরিষদ স্থগিতের ঘোষণা দেয়ার পরপরই তাকে মিলিটারি আগ্রাসনের প্রস্ততি নেবার আদেশ দেয়া হলে তিনি পদত্যাগ করেন।”

দ্যা গার্ডিয়ান ৩১মার্চ তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেন, “তিনি(ইয়াহিয়া) যখন মুজিবের সাথে আলাপ-আলোচনা করছিলেন, তার জেনারেল তখন হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিলেন।”

৪এপ্রিল দ্য বাল্টিমোর সান এ লেখা হয়, “কতটুকু ঠাণ্ডা মাথায় যে পশ্চিম পাকিস্তান  গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে বাঙালীদের নত করেছেন তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের ঐ গণহত্যার রাতের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডে।”

৪এপ্রিল দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস একই ঘটনা নিশ্চিত করে… “এটি এখন স্পষ্ট যে, পশ্চিম পাকিস্তানিরা কখনও সংলাপ সফল করতে চায় নাই, তারা নিজেদের এখানে এনেছিল শুধুমাত্র কালক্ষেপণ করতে যেন তারা ওই সময়ে আক্রমণ পরিচালনা করতে যথেষ্ঠ সৈন্যসহ শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে।”

২৯এপ্রিল হেনরি ব্রাডশের “ইভনিং স্টার” এ প্রতিবেদন করেন, “সাইক্লোনটি হয়তো এখনও তার পূর্ণ মূল্য বুঝে নেয়নি।“ এই উন্মোচনকারী মন্তব্যটি করা হয় জুলফিকার আলি ভুট্টো দ্বারা ৪ মার্চ একটি সাক্ষাৎকারের সময়। এর মাধ্যমে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি-আমলাতান্ত্রিক অভিজাতরা পূর্ব পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে রাখতে রক্তপাত পর্যন্ত করতে ইচ্ছুক। তিন সপ্তাহ পর, গত বৃহস্পতিবার, সেই রক্তপাত শুরু হয়…”

ফরাসী “লে মন্ডে” এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়ে বলেন, “কোনো ধরনের আপসের দিকে না গিয়ে, এমনকি এমন আপস দিকে চাচ্ছিল যেটায় বাঙালী স্বায়ত্তশাসনের সমর্থকদের চেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারই বেশি উপকৃত হতো, ইয়াহিয়া নিপীড়ন বৃদ্ধি করছে যা বর্তমানে নিষ্ঠুরতার এমন এক সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে যে এটি পূর্বপরিকল্পিত না হওয়াটাই হবে বিষ্ময়কর।”

 

১১মে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে দেয়া এক বক্তব্যে সিনেটর উইলিয়াম সেক্সবি বলেন, “আলাপ-আলোচনার ধুম্রপর্দার অন্তরালে, বিশাল পাঞ্জাবী পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করা হচ্ছিল, আর তার পুরো শক্তি এমনভাবে নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর উন্মোক্ত করা হয়, ডঃ রোড ও অন্যান্য সাক্ষীর বর্ণনায় যা ছিল পৃথকভাবে রক্তস্নান, জন-নিধন ও গণহত্যা।”

২০ জুলাই লন্ডনের দ্য টাইমস এ বলা হয়, “এটি নিয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই যে মার্চের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই চূড়ান্ত উপায় হিসেবে সেনাবাহিনীর ব্যবহার রাষ্ট্রপতি ও তার পরামর্শকদের মাথায় গেঁথে যায়। বড় মাত্রার সৈন্যবাহিনী পশ্চিম প্রান্ত থেকে উড়িয়ে আনা হয় – যদিও তা মিলিটারি কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে – এই উড়িয়ে আনার কাজ গোপনে পুরো মাস জুড়ে চলতে থাকে।”

২ আগস্ট, ১৯৭১ সালে নিউজউইক ম্যাগাজিন “বাংলাঃ গণমানুষের হত্যাকাণ্ড” শীর্ষক একটি কভার-স্টরিতে লেখা হয়, “ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক বসার কয়েক সপ্তাহ আগেই রাষ্ট্রপতি ও তার ডান হাত লেঃজেঃ টিক্কা খান মুজিবকে গ্রেফতার, আওয়ামীলীগ ভেঙে দেওয়া ও বাঙালী জাতীয়তাবাদীদের হত্যার নীল নকশা করে ফেলেন।”

 

ম্যাগাজিনে আরও লেখা হয়, “টিক্কা খান বাংলায় সেনাবাহিনীর শক্তি গড়ে তোলার জন্য কালক্ষেপণ  করতে ইয়াহিয়াকে দৃশ্যত প্ররোচিত করেন। তদনুযায়ী, ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে আলোচনার খাতিরে দর কষাকষি করেন। আর যখন এই এই নেতা আলোচনা করছিল এবং বাঙালী, সাথে সমগ্র বিশ্ব, পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে এমন একটি সমঝতার দিকে তাকিয়েছিল, তখন সেনাবাহিনী একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটায়। দক্ষিণ ভারতের পাশ দিয়ে দীর্ঘ জলসীমার উপর দিয়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক বিমান দ্বারা পরিচালিত বোয়িং ৭০৭ এ করে উড়ে এসে, বাংলায় সেনা সংখ্যা ৬০,০০০ পর্যন্ত উন্নীত করে সেনাবাহিনী তাদের শক্তি দ্বিগুণ করে ফেলে। যখন টিক্কা কথা দেয় যে সবকিছু প্রস্তত, ইয়াহিয়া ঢাকা ছেড়ে আকাশপথে চলে যায়। আর সেই রাতেই, বেলুচিস্তানের বোমারু (টিক্কা খান) তার সেনাবাহিনী উন্মুক্ত করে।”

২আগস্ট, ১৯৭১ এ প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনঃ

“মার্চে নির্ধারিত সাংবিধানিক অধিবেশনকে সামনে রেখে, ইয়াহিয়া রাতে সাদা পোশাকে পূর্বে উড়ে আসা সৈন্যদের নিয়ে গোপনে বাহিনী গঠন শুরু করেন। তারপর তিনি এটি বলে অধিবেশন পিছিয়ে দেন যে, মুজিব পূর্বাঞ্চলের জন্য কতটুকু ক্ষমতা ও স্বারত্তশাসন চান তা সূক্ষ্মভাবে নিরূপণ না করে অধিবেশনে বসা সম্ভব না। মুজিব পূর্ণ স্বাধীনতায় সমর্থন দেননি, বরং চেয়েছিলেন এমন একটি জাতীয় ঐক্যের স্খলিত আভাস চেয়েছিলেন যার নেতৃত্বে প্রত্যেক পার্শ্ব তাদের নিজস্ব কর, বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য নিয়ন্ত্রণ করবে। ইয়াহিয়া ও জেনারেলদের কাছে এটি ছিল অগ্রহণযোগ্য। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া তার চালিয়ে রাখা আলোচনা ভেঙে দেন এবং ইসলামাবাদ চলে যান। পাঁচ ঘণ্টা পর, ক্ষুদ্র কামান, ট্যাঙ্ক ও রকেট ব্যবহার করে সেনাবাহিনী ঢাকার আধ ডজন সেকশনে সেনা আক্রমণ চালায়।”

২৩ আগস্ট টাইম ম্যাগাজিনে লেখা হয়, “গত ডিসেম্বরের সাংবিধানিক পরিষদের নির্বাচনে  শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ পূর্বের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে মহাজয় লাভ করে। এটি ৩১৩ আসনের জাতীয় পরিষদে মুজিবের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করেছিল, সাথে এটিও নিশ্চিত করেছিল যে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন। এটি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাধর গোষ্ঠী যারা ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকে ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত এই দেশটি পরিচালনা করে আসছে, তাদের সতর্ক করার জন্য যথেষ্ঠ ছিল। ইয়াহিয়া ও তার দল ভয় পাচ্ছিল মুজিবের উত্থানের অর্থ হতে পারে দীর্ঘদিন ধরে শোসিত পূর্ব পাকিস্তানে বৃহত্তর কোনো স্বায়ত্তশাসন, আর তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালী আন্দোলন নৃশংসভাবে পিষে দমন করে।”

 

সবশেষে এপ্রিলের ৪ তারিখে সানডে টেলিগ্রাফে গণতন্ত্র ধ্বংসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চস্তরের চরিত্র এবং পরিকল্পনা বিশ্লেষণ করেন ডেভিড লোশাক।“ইয়াহিয়া কর্তৃক শুরু করা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এই মানুষগুলো কখনোই বিশ্বাস স্থাপন করে নাই।তারা বিশ্বাস করে নাই কারণ প্রকৃতি গত ভাবে,বেড়ে উঠার বা বিশ্বাসের দিক থেকে তারা গণতান্ত্রিক নয় বরং স্বৈরাচারী,পুরুষতান্ত্রিক এবং একপক্ষীয়।বিংশ শতকের থেকে আঠারো শতকের মত সাধারণ জনগণের প্রতি তাদের ঘৃনা সূচক মনোভাব রয়েছে,তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে পাকিস্তানের কর্তৃত্বকারী অংশ হিসাবে তাদের সমগ্র ভবিষ্যৎ বেসরকারি সরকারের নিকট শান্তিপূর্ন ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের দ্বারা হুমকির সম্মুখীন হবে, যেমনটা একমাস আগেও অতি নিকটে (যদিও কখনো ছিলো না) বলে মনে হয়েছিলো।তাদের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও তার বেসামরিক মন্ত্রীসভা কর্তৃক একটি নির্বাচিত বিধানসভার নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রস্তুতকৃত যথাযথ পদক্ষেপগুলো পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোর বাস্তবতা আড়াল করার বাহানা ছাড়া আর কিছু ছিলো না।তারা ডিসেম্বরের নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভরসা করেছিল।সামরিক শাসন দীর্ঘ করার জন্য সেটাই হত সবথেকে বৈধ অজুহাত। এর পরিবর্তে এই নির্বাচন এক নেতা ও এক দল পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগ কে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদান করে।ডিসেম্বরের ৭ তারিখ থেকেই জেনারেল ও কর্নেলরা জানতেন যে তাদের কি করতে হবে।এটি তখন শুধুমাত্র একটি অজুহাতের অপেক্ষা ছিল……………ততদিনে সেনাবাহিনী সতর্কতার সাথে সম্ভাব্য পরিকল্পনা তৈরি করে ফেলেছিল। এর গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আওয়ামী লীগে পুরোপুরি ভাবে অনুপ্রবেশ করেছিল।পরিষ্কারভাবে বলা যায় প্রেসিডেন্ট যখন শেখ মুজিবের সাথে সাংবিধানিক আলোচনার শেষ গোলটেবিল বৈঠক করছিলেন তখনই প্রেসিডেন্টের নতুন সামরিক আইন প্রশাসক লে.জেনারেল টিক্কা খানের ব্যক্তিগত নির্দেশনায় চুড়ান্ত প্রুস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল।”

যখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মুজিবের সাথে আলোচনা করছিলেন তখন তিনি অবশ্যই সেনাবাহিনীর প্রুস্তুতি সম্পর্কে যানতেন।ঘটনা পরিক্রমার সাক্ষ্যে প্রেসিডেন্টকে ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকার দায় থেকে মুক্তি দেয়া কঠিন।”

গণহত্যা

বিশ্বের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নিশ্চিত যে জেনারেল ইয়াহিয়া ও তার সরকার গণহত্যার দায়ে দোষী।তার দখলদার সেনাবাহিনীর মিশন হচ্ছে “ প্রত্যেক বাঙালি কে হত্যা পোড়ানো।” একটি জাতি ও জনগোষ্ঠী কে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল এবং অতি সতর্কতার সাথে এর খুঁটিনাটি পালন করা হয়েছিল।গণহত্যা কনভেনশনের আর্টকেল ২ অনুযায়ী এই অপরাধ হচ্ছে “সেই সব কাজ যা কোন জাতি,জাতিগত,বর্ণের বা ধর্মীয় দল কে সম্পূর্ন বা আংশিক ভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ঐ দলের সদস্যদের হত্যা বা গুরুতর শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি করার মাধ্যমে….।”বর্তমানে অধিকৃত এলাকায় যে নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেয় তাকে পাঞ্জাবি সেনাদল গুলি করছে এবং একইভাবে হিন্দুদেরও নিশ্চিহ্ন কর হচ্ছে।যে ধরণের নৃশংসতা করা হয়েছে তার কোন তুলনা বর্তমান সময়ের ইতিহাসে নেই।

কিভাবে এই উদ্দেশ্যমূলক গণহত্যা শুরু করা হয়েছিল তা মার্চের ২৬ তারিখে ঢাকা থেকে বহিষ্কার হবার পূর্ব পর্যন্ত থাকা প্রায় সকল বিদেশী সাংবাদিক এবং সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হবার পরে যারা বাংলাদেশে গিয়েছেন,তারা লিখেছেন।তাদের মতে এভাবেই সব শুরু হয়েছিলঃ

ওয়াশিংটন পোস্টে হেনরি ব্রাডশের লিখেছেন “বৃহষ্পতিবার রাতে সেনাবাহিনী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং শুক্রবার সকালেও অনেক বেলা পর্যন্ত ভারী আর্টিলারি সহ গুলির আওয়াজ শোনা গেছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে প্রকান্ড অগ্নিশিখা দেখা গেছে।”

 

এএফপি এর সাংবাদিক ব্রায়ান মে বলেন, “সারা রাত ধরে গোলাগুলির যে তীব্রতা ছিল এবং শুক্রবারে বিক্ষিপ্তভাবে তা যেভাবে বজায় ছিল তাতে বোঝা যায় শহরজুড়ে মৃতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সেনাবাহিনী বাঙালী অধ্যুষিত পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করে ফেলেছিল।

ইউপিয়াই এর রবার্ট কাইলর বলেছেন, “হোটেলের কাছে “দ্য পিপল” সংবাদপত্রের দিকে টর্চ হাতে সৈন্যদের যেতে দেখা গিয়েছে। সেখানে কিছু হট্টগোল এবং গোলাগুলি হলো আর অফিসে আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো… আগুনের প্রকাণ্ড লেলিহান শিখা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক হতে উপরের দিকে উঠে গেল। সৈন্যদল যদি ভারী অস্ত্রসস্ত্র সমেত হামলা চালিয়ে থাকে, তবে এই হত্যালীলা ব্যাপক আকার ধারণ করবে। ছাত্রাবাসগুলো যেগুলোর প্রতিটিতে ৪০০ করে ছাত্র ধরে সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দ্বারা ঠাসাঠাসি হয়ে যায়।

বিবিসি এর মাইকেল ক্লেয়টন রিপোর্ট করেন, “ঢাকাবাসিকে আতঙ্কিত করতে সৈন্যবাহিনী বৃহস্পতিবার রাতে এক নৃশংস অভিযান পরিচালনা করে।”

সিমন ড্রিং, ডেইলি টেলিগ্রাফ লন্ডন এর আরেকজন সাক্ষী, ৩০মার্চ লিখেন, “আকষ্মিক আক্রমণে ইকবাল হলে প্রায় ২০০ ছাত্র খুন করা হয় তাদের কক্ষগুলোতে মেশিনগানের গুলির ঝাঁজরায়… মিলিটারি অনেকগুলো মৃতদেহই সরিয়ে ফেলে কিন্ত ৩০টি দেহ তখনও সেখানে ছিল যেগুলো থেকে কখনই ইকবাল হলের করিডোরগুলোর এত রক্ত হওয়া সম্ভব না।

তিনি আরও বলেন, “যারা বাজারে ঘুমিয়ে ছিল তাদের গুলি করা হয়, সকাল বেলাও তারা একইভাবে শুয়ে ছিল কম্বল গায়ে, মনে হচ্ছিল যেন তারা ঘুমোচ্ছে। ২৬মার্চ সকালে গোলাগুলি বন্ধ হয়, পুরো ঢাকা নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে যায়। হঠাৎ শহর আবার সৈন্য দ্বারা ছেয়ে যায় এবং ১১ ঘণ্টা ধরে তারা এই পুরাতন নগরী ঢাকাকে ধ্বংস করে দেয়।” তিনি আরও বলেন, “সেনাবাহিনী পুরান নগরটির প্রতিটি মানুষকে গুলি করে এবং মানুষকে তাদের বাড়ির ভেতরে পুড়িয়ে মারে।  সবচেয়ে বড় গণহত্যাটি চলে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায়। সেনাবাহিনী তারপর পরবর্তী টার্গেট, শেখ মুজিবের সমর্থনকারীদের কেন্দ্রের দিকে ছুটে যায়, এই হত্যাযজ্ঞ রাত পর্যন্ত চলতে থাকে।”(সিমন ড্রিং ছিলেন একজন সাংবাদিক যিনি ২৬ মার্চ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের একটি কক্ষে লুকিয়ে থাকেন । ২৭মার্চ সকালে যখন কারফিউ তুলে নেয়া হয়, ড্রিং তখন এই হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা নিজ চোখে দেখতে পান।)

দ্য টাইমস, লন্ডন এর পিটার হ্যাজেলহার্স্ট তিনদিনের হত্যাযজ্ঞের পর বেঁচে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বক্তব্য তুলে ধরে বলেন, “কিছু মানুষকে আদেশ দেয়া হয় বিশাল কবল খোঁড়ার জন্য। পাকিস্তানি সেনারা ৮-৯ জন বাহককে বসতে বলে। কিছুক্ষণ পর দাঁড়াতে বলা হয় এবং কবরের পাশে সারিবদ্ধ হতে নির্দেশ দেয়া হয়। বন্দুকগুলো থেকে আবার গুলি করা হয় এবং তারা আমার বন্ধুদের মৃতদেহের পাশে পড়ে যায়।”

৩০ মার্চ জন উডরুফ দ্য বাল্টিমোর সান এ “পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার পরিকল্পিত আক্রমণ” শীর্ষক এক লেখায় লিখেন, “ প্রথমেই বেতারে কারফিউ ঘোষণা করা হয় মাঝ সকালে এবং তার ৮ ঘণ্টা পরে বিদেশি সাংবাদিকরা দেখতে পান  সৈন্যদের দ্বারা ১৫ জন নিরস্ত্র যুবক যারা আস্তে আস্তে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ করে এগিয়ে আসছিল তাদের উপর একটি জীপবাহী মেশিনগান চালানোর হয়।”

এসোসিয়েট প্রেস এর মাইকেল লরেন্ট নিউ ইয়র্ক পোস্ট এ প্রতিবেদন করেন, “তখনও পুড়তে থাকা যুদ্ধ এলাকাগুলো শনিবার ও গতকাল পরিদর্শনের সময় ছাত্রাবাসের বিছানায় একজন কিছু ছাত্রের পোড়া দেহ খুঁজে পায়। ট্যাঙ্কগুলো ছাত্রাবাসগুলোতে সরাসরি আঘাত হানে। জগন্নাথ হলে একটি গণকবর তড়িঘড়ি করে পূর্ণ করা হয় ইকবাল হলে হত্যা করা ২০০ জন ছাত্রের লাশ দিয়ে। প্রায় ২৯টি দেহ তখনও মাটিতে ও ছাত্রাবাসে পড়েছিল।”

 

দ্য টাইমস, লন্ডন এর লুইস হেরেন ২এপ্রিল লিখেন, “পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার যুদ্ধ শুরু করার জন্য দায়ী। বলা হয় তাদের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বদের সরিয়ে দেয়া, এটি সম্ভবত ভালভাবেই অর্জিত হয়েছিল।” উপসংহার টানা হয় যে, “পূর্ব পাকিস্তান অন্তত এক যুগ অথবা হয়তো একটি প্রজন্ম রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ত্ব ব্যাতীত থাকবে। আক্রমণ চালানোর কয়েক সপ্তাহ আগেই পশিম পাকিস্তানিরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থাকা বাঙালী সৈন্য ও অফিসারদের নিরস্ত্র করে ফেলে।”

২এপ্রিল দ্য নিউ স্টেটস্ম্যান এ মারভিন জোন্স লিখেন, “রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়ার ধন্যবাদ বিধ্বংসী অভিযানে রূপান্তরিত হয়ে যায়, পুর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি সেখানে কোনো পিছুটানই দেখানো হয়নি। আর স্থূল যুক্তিতে তাদের শত্রু নিশ্চই সমস্ত জনগণ কারণ তারা স্ব-শাসনের দাবীতে সর্বসম্মতি দেখিয়েছে।”

৮এপ্রিল লন্ডনের দ্য ইভনিং স্ট্যান্ডার্ডে লেখা হয়, “হাজার হাজার বাঙালী খুন করা হয়। সেনাবাহিনী মানুষকে জড়ো করে তার মেশিনগান দিয়ে… তাদের পেছন থেকে কুকুরের মতো গুলি করে মারা হয়।”

২০জুলাই মাইকেল হর্ন্সবাই দ্য টাইমস এ লিখেন, “এটি নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশের উপর পদ্ধতিগত নিপীড়ন চালায়।”

ডেইলি টেলিগ্রাফ এর ১২এপ্রিলের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, “যা হচ্ছে তা ঔপনিবেশিক দখলদারীত্ত্বের যুদ্ধ থেকে কম হলেও অন্তত একটি গৃহযুদ্ধ অথবা বিদ্রোহীদের উপর নিপীড়ন। কঠোর সেন্সরশিপ ও বিদেশি সংবাদদাতাদের নির্বাসনের ফলে সাক্ষীদের দ্বারা জানানো নৃশংসতা নিশ্চিতভাবে বলা অসম্ভব, কিন্ত ভয়ঙ্করতম ভয় জাগিয়ে তোলার জন্য এটি পর্যাপ্ত।”

সিলেট, বাংলাদেশ থেকে ডেভিড লোশাক ১৫এপ্রিল দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ এ প্রতিবেদন করেন, “সাত লাখ মানুষের প্রায় সবাই গ্রামের দিকে পালিয়ে গিয়েছে শহুরে রাস্তাগুলো অসহায় বৃদ্ধ ও বিকলাঙ্গদের আর লাশগুলো কুকুর ও শকুনদের জন্য ছেড়ে দিয়ে। স্ফীত লাশগুলো সিলেটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত সুরমা নদীতে ভেসে উঠছিল। এগুলো ছিল ২৬মার্চ, ১৯৭১ এর রাতের প্রত্যয়নপত্র যে রাতে পশ্চিম পাকিস্তানিরা শহরে হানা দেয় এবং লুট ও হত্যার অভিযান চালায়। একটি বিশেষ ইউনিটকে দায়িত্ব দেয়া হয় ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষদের হত্যা করার জন্য।”

১৬এপ্রিল লন্ডনের দ্য নিউ স্টেটস্ম্যান লিখে, “রক্তই যদি জনগণের স্বাধীনতার অধিকারের মূল্য হয়, বাংলাদেশ তবে অতিমুল্য প্রদান করেছে… ধর্মনিষ্ঠভাবে প্রয়োজনীয়, যেমনটা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পশ্চিমের কাছে দাবীগুলো জানায় ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে, তারা তাই করেছে। তারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নিখিল-পাকিস্তান পরিষদে জয়লাভ করে। এটি ছিল দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন এবং যার ফলাফল প্রচণ্ড ধাক্কা দেয় ইয়াহিয়া খানের ইসলামাদ সরকারকে যে সরকারের মূল শক্তি ছিল সেনাবাহিনী যেখানে বাঙালীরা ছিল উপেক্ষিত, ইসলামাবাদ আতঙ্কিত হয়ে যায়। যার ফলাফল হলো এই হত্যাযজ্ঞ।”

১৭এপ্রিল, ১৯৭১, সিডনি স্ক্যানবার্গ পালাতে সক্ষম হওয়া এক নব্বই বছর বয়স্ক বৃদ্ধ সেকেন্ড ল্যাফটেনেন্ট এর উদ্ধৃতি দিয়ে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এ লিখেন, “একটি জানালা দিয়ে তিনি দেখেন পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা রেজিমেন্টের ৬০জন বাঙালী সৈন্যকে একটি ভবনের পেছনে নিয়ে যায়, তাদের হাত উপরে তোলা ছিল। তারপর তিনি একটানা গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পান এবং বুঝে নেন বাঙালীদের হত্যা করা হয়েছে।”

 

” বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরী অবস্থায় অান্তর্জাতিক কমিটির” পরিচালনা কমিটি নিউইয়র্ক  থেকে “হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড, ইন্ডিয়া ২৪ এপ্রিল, বিবৃতি দেয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান টার্গেট, গণহত্যা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে এবং নির্যাতিতদের মাস্টার লিস্ট তৈরী করা হচ্ছে। নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যেমন চিত্রশিল্পী, গায়ক ও লেখক, যারা বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সাথে জড়িত ছিলেন তারা নির্যাতিত হন। গণহত্যা ছিল নিষ্ঠুরতম ও শোচনীয় দৃশ্য।

সিরিয়ার অাল-থাওরা উল্লেখ করে পশ্চিম পাকিস্থানী সৈন্যরা পূর্ব বঙ্গে সুসসংগঠিত গণহত্যা চালাচ্ছে।

টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা  ডান কগিনস্ ছিলেন অন্যতম একজন সংবাদদাতা যিনি ২৬ তারিখে সন্ধ্যায় মিলিটারি কর্তৃক  ঢাকায় সংবাদ সংগ্রহ থেকে বরখাস্ত হন। কিন্তু পরবর্তীকালে তিনি প্রথম অামেরিকান সাংবাদিক হিসেবে ঢাকার বিখ্যাত সড়কে ট্রাক ও সাইকেলে ভ্রমন করেন। তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেন বর্বরতা অাপাত দৃষ্টিতে অবিরাম। এক যুবককে সৈন্যরা খুজে বের করে। ওই যুবক তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং বলে তার ১৭ বছরের ছোট বোনকে ছেড়ে দিতে এবং বিনিময়ে সে সবকিছু করবে। কিন্তু ওই যুবকের সামনে তারা তার বোনকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করে। কর্নেল অাব্দুল হাই একজন ডাক্তার যিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিলেন, তাকে তার পরিবারে শেষ ফোন করতে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। এবং এক ঘন্টা পরে তার দেহ তার বাড়িতে প্রেরণ করা হয়। একজন বৃদ্ধ যিনি কারফিউ থেকে জুম্মার নামায অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেন, তিনি মসজিদ বরাবর হাটতে থাকলেন কিন্তু গুলিতে নিহত হলেন।

উদঘাটিত রির্পোটের মাঝে সব থেকে আলোচিত হচ্ছে  “এনথনি মাসকারেনহাস এর চার পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি যা  “সিডনি টাইমসে ১৩ জুন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, এই গণহত্যা পরিচালনা করা হয়েছিল নিপীড়িত মানুষদের ভয় দেখানোর জন্য। মাসকারেনহাস পাকিস্থানী সৈন্যদের অাতিথীয়েতায় সারাদেশ ভ্রমনের সুযোগ পান এপ্রিল ১৯৭১। তিনি দ্রুত তার লেখা শুরু করেছিলেন এবং নাম দিয়েছিলেন “গণহত্যা”। তিনি লেখেন, অামি মনে করি, পূর্ব বাংলা সরকার চুক্তিপত্রের বিরোধীতা করেনি। পূর্ববঙ্গ এখন অধ্যুষিত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাঘের উপর বসে হিসাব নিকাষ করছেন। কিন্তুু সৈন্যরা সেখানে থেমে থাকেনি। পাকিস্থান সরকারের চুক্তি পূর্ববঙ্গের জন্য সেটা পড়লাম ঢাকার ইস্টার্ন হেডকোয়ার্টারসে্। এটার তিনটি তত্ব ছিল। (১) বাঙালিরা তাদের নিজেদের অনির্ভরযোগ্য করবে এবং পশ্চিম পাকিস্থানের অাইন মানবে। (২) বাঙালিদেরকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা এবং সাংবিধানিক ভাবে ইসলাম গঠন এবং শক্তিশালী ধর্মীয় সম্পর্ক পশ্চিম পাকিস্থানের সাথে গঠন করা। (৩) হিন্দুদের মারা যাওয়ার পর সে সম্পদ মধ্য শ্রেণীর মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এটা সাংবিধানিক গঠন শক্ত ও রাজনীতির কাঠামো ভবিষ্যতে শক্ত করবে। এবং এই চুক্তি সর্বাধিক ভারসাম্য রক্ষা করবে।

 

জুলাই ১৪, ডেইলি মিরর পত্রিকাতে বলা হয়…”এটা যখন পরিস্কার যে পূর্ব পাকিস্থানে যা ঘটেছিল যা শুধু উপপ্লবের চাপাচাপিই ছিল না, ছিল গণহত্যা। পশ্চিম পাকিস্থানী সামরিক সরকার চিহ্নিত  গণহত্যার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন এবং বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন মানুষের মাঝে ২% মানুষকে অনাহারে রাখেন।

২০ জুন, লন্ডনের “দ্য সিডনি টাইমস্” একটি সম্পূর্ণ পৃষ্ঠার খবর প্রকাশ করে “পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ” নামে। এবং বলা হয় এই গণহত্যার সাথে ইয়াহিয়া সরকার জড়িত। এবং এই হত্যা প্রচারণা লাগামহীনভাবে ছাড়া হয় বাংলাদেশে। হত্যা করা হয় শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, হাকিম, ডাক্তার, হিন্দু এবং অাওয়ামীলীগারদের। গুপ্ত পুলিশদের কাজ প্রসারিত ছিল। এটা রাজাকারদের প্রধান কাজ ছিল। বিহারী অার অস্ত্র সজ্জিত কর্মীরা সিনিয়র অফিসারদের সহায়তায় লুটপাট, মেয়েদের ধরে নিয়ে যাওয়া, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি এবং এধরনের অারো অনেক কাজ করাতো।

চট্টগ্রামের অাগ্রাবাদে পতিতালয় চালানো হয় এবং, মেয়েদেরকে অফিসারদের কাছে পাঠানো হত পার্টিতে অংশ নেয়ার জন্য। সেনা গোয়েন্দারা সন্দেহভাজনদের তালিকা তৈরী করে। তারা সাদা, ধূসর ও কালো তিনভাগে বিভক্ত হয়। সাদারা অসংযতভাবে ঘোরে, ধূসররা অবরুদ্ধ করে এবং কালোরা গুলিকরে হত্যা করে। অনেক সন্দেহভাজনকে প্রকাশ্যে ধরা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হয়। এবং তারপর অার তাদের দেখা যায় নি। এরকম অনেক উদাহরণ অাছে।

টনি ক্লিফটন ২৮ জুন, নিউজউইক ম্যাগাজিনে জন হাসটিংসের বরাত দিয়ে বলেন, (জন হাসটিংস একজন ব্রিটিশ মিশোনারী, যিনি ২০ বছর ইন্ডিয়া ছিলেন) তিনি বলেন, অামি নিশ্চিত যে, পাকিস্থানী সৈন্যরা মেয়েদেরকে ক্রমাগত ধর্ষণ করছে এবং দুই পায়ের মাঝে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে হত্যা করছে। ক্লিফটন অারো বলেন, এই গণহত্যা এলোমেলো ছিল না। এটা পরিকল্পিতভাবে চালনা করা হয়েছিল বাঙালীদের নির্মূল করার জন্য।

জুন ২৮, লন্ডনের “দ্য গার্ডিয়ান ” পত্রিকায় মার্টিন উল্লাকট বলেন “খুন, ধর্ষণ, লুট এবং অগ্নী সংযোগের পর কুমিল্লা জেলাকে নিরাপদ বলার কোন সঠিক কারণ আছে কি? ।”

সিডনি স্ফানবার্গ যাকে পাকিস্থানী সৈন্যরা বরখাস্ত করেছিল ৩০ জুন। তিনি বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে ২৯ জুন লিখেছিলেন, পাকিস্থানী সৈন্যরা হলুদ রঙের বড় এইচ লিখেছিল হিন্দুদের দোকানে এবং সংখ্যা লঘুদের সম্পত্তিতে যাতে জনগণ  বুঝতে পারে এগুলো তাদের অন্যতম লক্ষ্য।

স্ফানবার্গ ৪ জুলাই অাবার লেখেন, পৃথিবী কি বুঝতে পারছে না যে এই পাকিস্থানী সৈন্যরা ধোঁকাবাজ? তিনি একজন বিদেশীকে জিজ্ঞেস করেন যিনি অনেক বছর যাবৎ পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস করছেন। তিনি বলেন “তারা বাঙালীদের ভয় দেখানোর জন্য হত্যা করেছিল এবং বাংগালিদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়? তারা সব গ্রাম মুছে ফেলতে চাইছিল। প্রথমে তারা অাগুন দিয়ে পোড়াচ্ছিল এবং তারা থামতো যতক্ষণ না তারা নিজেরা  ক্লান্ত হতো?

৫-ই জুলাই “দ্য হংকং স্টানর্ডাডে” লেখা হয়, ” ইয়াহিয়া খানের সৈন্যর মানব জাতির রক্তাক্ত কাহিনীর একটা ভয়াবহ নতুন রেকর্ড করে ।”

ইউনাইটেড আরব রিপাবলিকের “অাল-অাহরাম” পত্রিকার সম্পাদক হোসেইন হেইফাল ৯ জুলাই লেখেন, “অামরা কিভাবে নিরবে থাকতে পারি যখন পূর্ব পাকিস্তানে  একচতুর্থাংশ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে যা কিনা ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক হত্যাকান্ড?”

 

১২ই জুলাই নিউইয়র্ক টাইমসে অ্যান্থনি লুইস লিখেছেন, ” দুষ্কৃতকারীদের সাথে ডিল করার নামে দৃঢ়তা শূন্য পাকিস্তান যে অপপ্রচার চালায় তা আসল সত্যকে আড়াল করতে পারেনা যে, পাকবাহিনীর হত্যা এবং ত্রাসের রাজত্ব জাতি ও রাজনীতির তলানিতে ঠেকেছে”। জুন ‘৭১ সালে বাংলাদেশে একটি ব্যাপক সফর শেষে বিশ্বব্যাংকের ১০জন প্রতিনিধি একটি যৌথ প্রতিবেদন দাখিল করেন। এই প্রতিবেদনের সাথে পাকিস্তান বিভাগের আইবিআরডি’র অর্থনীতিবিদ Mr. Hendrik Van der Heijen এর মন্তব্য দাখিল করা হয়; যিনি বলেছিলেন, ” কৃষকেরা শহরগুলিতে আসছেনা এবং কেই শহরের বাইরেও যাচ্ছেনা। হাজার হাজার কৃষক পালিয়ে গেছে। সেখানে সবকিছু অস্বাভাবিক এবং এটি একটি ধ্বংসাত্মক অভিজ্ঞতা।” Mr. George Broussin ফ্রান্সের La Politique De Matin এ লিখেছেন, ” যেসব অপরাধ বর্ত্তমান বিশ্বকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একটি ঘটছে বাংলাদেশে যা মানবজাতির জন্য সবচেয়ে মারাত্মক ও সবচেয়ে বিপর্যয়কর।” ২১জুলাই,১৯৭১ সালে International Herald Tribune এর প্রতিবেদন :- “পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে জ্ঞাপিত তরঙ্গের মতন গ্রাম দহন এবং ধর্ষণের পর গত কয়েক মাসে একলক্ষ পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থী -যাদের প্রায় বেশিরভাগ মুসলিম ; ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পালিয়ে যায়।”

 

টাইম ম্যাগাজিনের আগস্ট ২, ১৯৭১ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিলো :- ” গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে রক্তপাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। নগরের প্রতিটি অংশে বোমাবর্ষণ এবং বায়বীয় আক্রমণের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা যায়। খুলনা উত্তরাঞ্চলীয় শহরতলি খালিশপুরে নগ্ন শিশু এবং জীর্ণশীর্ণ নারীদেরকে ধ্বংসস্তূপের ময়লা সাফ করতে দেখা যায় যেখানে একসময় তাদের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট দাঁড়িয়ে ছিলো। চট্টগ্রামের হাজারি লেন ও মাওলানা শওকত আলী রোডের বিস্তৃতি অপনোদিত হয়েছে। যশোর কেন্দ্রীয় বাজার ঢেউতোলা টিন ও টুটা দেয়ালের সাথে মানুষ দুমড়ে মুচড়ে দলায় পরিণত হয়েছে। চল্লিশ হাজারের জনসংখ্যার একটি শহর কুষ্টিয়া,যা এখন, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ” পারমাণবিক হামলার পর একটি সকালের মতো। ” ঢাকায় সৈন্যদল অগ্নিবর্ষকের মাধ্যমে আগুন জ্বালিয়ে দেয় এবং যারা অগ্নিবেষ্টনী থেকে পালানোর চেষ্টা করে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। প্রায় ২৫টি ব্লক বুলডোজারের মাধ্যমে গুড়িয়ে দেয়া হয়।”

 

ক্লেয়ার হলিংসওর্থ কতৃক ঢাকা থেকে প্রেরিত একটি ডাকের মাধ্যমে ৫ই আগস্ট, ১৯৭১ সালে The Daily Telegraph লিখেছে- ” গত চারমাসে সৈন্যদলের কার্যপদ্ধতি খুব সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। যুবকদের দ্রুত বন্দী অবস্থায় ট্রাকে করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিকটতম বন্দিশালায় নিয়ে যাওয়া হয়। বৃদ্ধ নর-নারী পলায়নপর অবস্থায় সৈন্যদের বুলডোজার নিয়ে তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করার প্রস্তুতি নিতে দেখে।” ১লা এপ্রিল ইউ এস সিনেটের এক অধিবেশনে সিনেটর এডওয়ার্ড এম. কেনেডি তার বিবৃতিতে বলেছেন, ” এটি নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের একটি গল্প। প্রতিদিন ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ফাঁসি হচ্ছে এবং প্রতিঘন্টায় হাজার হাজার বেসামরিক ছাত্র-জনতা দুর্দশা ভোগ করছে এবং মৃত্যুবরণ করছে। এটি স্থানচ্যুতি এবং বাস্তুহারা হওয়ার একটি গল্প।” ১১ই মে ইউএস সিনেটে সিনেটর Saxbe তাঁর বক্তৃতায় Doctor Rodhe কে প্রত্যক্ষদর্শী উল্লেখ করে যা বলেছে, তাতে স্পষ্ট হয় যে, পূর্বপাকিস্তানে জঙ্গলের আইন বিরাজমান যেখানে নিরস্ত্র বেসামরিক জনসাধারণকে গণহারে হত্যা করা হচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে এবনফ হিন্দু নিধন কার্যক্রম দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে।”

 

পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করে ১৯৭১ সালের জুন মাসে ১১জন প্রিভি কাউন্সিলর সহ বৃটিশ পার্লামেন্টের প্রায় দুই শতাধিক সদস্য এবং ৩০জন সাবেক মন্ত্রীবর্গ নিম্নলিখিত প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেন। ” এই হাউস বিশ্বাস করে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বৃহৎ মাত্রায় পূর্ববাংলার বেসামরিক নাগরিকদের উপর যে হত্যা এবং নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা পাকিস্তান কতৃক স্বাক্ষরিত ‘ইউনাইটেড নেশন্স কনভেনশন অন জেনোসাইড’ এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এবং এটা নিশ্চিত হয় যে পাকিস্তানের সামরিক সরকার পূর্ববাংলার অধিকার বাজেয়াপ্ত করেছে এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের প্রকাশিত গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে গ্রহণ করতে সেচ্ছামূলক অস্বীকৃতি জানিয়েছে। কাজেই বিশ্বাস করা হয়, আন্তর্জাতিক শান্তি এবং জেনোসাইড কনভেনশন লংঘনের হুমকিস্বরূপ উভয় পরিস্থিতি বিবেচনা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কতৃক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হবে এবং আরো বিশ্বাস করা হয়, যতক্ষণ এই আদেশ পূর্ববাংলার মানুষের আত্মসংকল্প প্রকাশের বাহন হিসেবে স্বীকৃতি না পায় ততক্ষণ এই আদেশ বহাল থাকবে।” সপ্তাহব্যাপী ভারতের শরণার্থী শিবিরে সফরের পর ২৬ আগস্ট এডওয়ার্ড কেনেডি আরেকবার বলেন, ” শরণার্থীর বলেছে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দোসরদের নৃশংসতার গল্প; হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের গল্প। পশ্চিম পাকিস্তানি জেনারেল এবং বিশ্ববাসীর কাছে এটা প্রমাণ করা আবশ্যক , যে বিস্ময়কর সংহার পূর্ববাংলাকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব গভীর অ স্থায়ী ভাবে পরিবর্তন করেছে।”

 

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ধ্বস :- ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কঠোর ব্যবস্থার পর ইয়াহিয়া খান বারবার দাবি করে আসছিলেন যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। এটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং অনেকের সন্দেহ – ইয়াহিয়া খান জানেন না যা তিনি অধিষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করছেন তা আদৌ বাংলাদেশে ঘটছে কিনা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ” লোকজন বাইরে যেতে সাহস করেনা এবং যার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যত স্থগিত হয়ে গেছে এবং সাধারণ অর্থনৈতিক কার্যকলাপেও ভাটা পড়েছে।” ” প্রথমত যে বিষয়টা একজন মানুষকে তাড়িত করে তা হলো- ঢাকা কিংবা গ্রামাঞ্চলের দিকে ভ্রমণের সময় আশেপাশে খুব কম লোকই মনে হবে।” ” অন্ধকারে পরিস্থিতি এখনো অত্যধিক অস্বাভাবিক। অধিকাংশ এলাকায় কারফিউ চলছে। সময় যাই হোক না কেন, মধ্যদুপুরের পর থেকেই রাস্তা ফাঁকা হতে থাকে এবং সম্পূর্ণরূপে অন্ধকার দ্বারা পরিত্যক্ত হয়।” ” প্রায় ৩মাস ধরে সেখানকার কারখানা বা বন্দরে কার্যত পাট, চা অথবা অন্যকোন রপ্তানি মালের আসাযাওয়া নেই এবং বিদেশের বন্দর থেকেও খুব কমই রপ্তানি হত।” ” সড়কপথে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫-১০ শতাংশ যানবাহনের চলাচল কোথাও নেই। এবং কিছু মাছ ধরার কার্যক্রম ছাড়া জলপথে নির্জনতা প্রতীয়মান হয়।দেশীয় নৌকা প্রায় দেখাই যায়না।” ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংক টিমের এই রিপোর্ট আসা অবধি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি।

 

টাইম ম্যাগাজিন, ২রা আগস্ট, ১৯৭১ সংখ্যার প্রচ্ছদকাহিনীতে লিখেছে,“পশ্চিমা জগতের মানুষের কাছে এই যুদ্ধকে সরকারিভাবে “দুর্বৃত্ত” দের বিরুদ্ধে অভিযান হিসেবে ভুলভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে।”

এই যুদ্ধের কোন খবর বিদেশী পত্রিকা মারফত যাতে দেশে না ঢুকতে পারে তার জন্য কড়া সেন্সরশীপ আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া যত বেশি সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত হয়ে দেশে ফিরে যাচ্ছে, যত তরুণ সামরিক কর্মকর্তার কফিন পাঠানো হচ্ছে, বিরোধিতা আরো বাড়ছে। অর্থনৈতিক আঘাত ইতিমধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে,কারখানাগুলোতে ব্যাপক কর্মী ছাঁটাই হচ্ছে কেননা, বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কাঁচামাল কেনা যাচ্ছে না।

বলতে গেলে অর্থনীতি পুরোপুরি ধ্বসে পড়েছে। এটা নিশ্চিত করা যায় বিশ্বব্যাঙ্কের পরামর্শ পর্যালোচনা করে যেখানে বলা হচ্ছে “যতদিন পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানে মিলিটারি থাকবে এবং বেসামরিক প্রশাসনকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করা হবে ততদিন অবস্থা স্বাভাবিক হবে না।“

সৈন্যদের এই ভূমি ত্যাগ

পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সকল খাদ্যভান্ডার হয় লুট করেছে অথবা পুড়িয়ে দিয়েছে এবং কৃষিকাজ এবং খাদ্যউৎপাদনের অনুপস্থিতিতে সম্পুর্ণ পরিস্থিতি বিকট রুপ ধারণ করেছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহের অভাবে সৈন্যরা তাদের টিকে থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার প্যাট্রিক ক্যাটলি, ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখে লিখেন, “সকল প্লাটুন,কোম্পানী ও ব্যাটালিয়নের অধিনায়কদের তাদের বাহিনীসহ ঢাকা ত্যাগ করার ব্যাপারে আদেশ জারি করা হয়েছে।”

এর থেকে বোঝা যায়,প্রয়োজনীয় সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে এবং সম্ভবত কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সমস্যায় ভুগছে।ব্যাপক সেনা অভিযানে বেয়নেটের মুখে পাকিস্তানী সৈন্যরা যে তাদের খাদ্য যোগাড়ের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা দিন দিন কঠিন হচ্ছে।

লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় ২৪ জুন মাইকেল হর্নসবি লেখেন, “আগামী চারমাসের মধ্যে একটি বড়ধরণের দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা আছে যা বছরখানেক চলতে পারে।হাজার হাজার লোক মারা যেতে পারে-ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে যে পরিমাণ লোক আছে তার চেয়েও বেশি হতে পারে মৃতের সংখ্যা এবং আরো কোটি কোটি লোক অপুষ্টির শিকার হতে পারে।

 

বেসামরিক প্রশাসন

বাংগালি বেসামরিক ব্যক্তিরা পাকিস্তানী সেনাকে সম্পূর্ণরুপে অসহযোগিতা করার কারণে ইয়াহিয়া খানের সরকার হাজার হাজার পশ্চিম পাকিস্তানীকে আনে প্রশাসন চালানোর জন্য।লন্ডনের “সানডে টাইমস” জুনের ২০ তারিখে লিখেছে “সব হিন্দু এবং আওয়ামী লীগারদের ব্যাঙ্ক একাউন্ট জব্দ করা হয়েছে এবং ৩০০০ পাঞ্জাবী পুলিশকে ঢাকার পাহারার দায়িত্ত্বে আনা হয়েছে।”

জুনের ২৫ তারিখে Schanberg  লিখেছে “পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অবশ্যই পুরো শহর নিয়ন্ত্রণে রেখেছে ,কিন্তু সরকার যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক বলছে, সেই স্বাভাবিকতার কোন চিহ্ন নেই।”

 

নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ১৩ জুলাই তারিখে Sydney Schanberg লিখেন,-“প্রতিদিন যে একের পর এক পশ্চিম পাকিস্তানী লোকবহর এসে পৌছাচ্ছে তার উদ্দেশ্য সরকারি কাজগুলোতে পূর্ব-পাকিস্তানিদের জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের বসানো। কোন দায়িত্বশীল পদে বাংগালিকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না,এমন কি ঢাকা এয়ারপোর্টের ঘাস কাটে যে লোকটি সেও একজন অবাংগালী।

লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ জুলাই এর ১৯ তারিখে লিখেছে-“ঢাকার শেষ কয়েক সপ্তাহের পরিস্থিতি, শহুরে গেরিলা গ্রুপ গুলোর ট্রেনিং ও সাংগঠনিক উন্নতির ফলাফল। পুর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক দূরে,এই জন্য সামরিক গভর্ণর টিক্কা খান ও তার সহকর্মীরা চেষ্টা করছেন যেন প্রেসিডেন্টের সফর পিছিয়ে যায়।”

এটি উল্লেখ্য যে টিক্কা খানের এই প্রচেষ্টা সফল হয়েছিল, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ভয়ে বাংলাদেশ সফর করতে সক্ষম হননি।

 

জনগণের নীতিবোধ

বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী জনগণের পূর্ণ সমর্থন উপভোগ করছিল, পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের ক্রমাগত সন্ত্রাস সৃষ্টি সত্ত্বেও জনগণের নৈতিকতাবোধ অনেক উন্নত ছিল।

Clare Hollingsworth ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট লন্ডনের ডেইলী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেন, “যখন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা ধারে কাছে থাকে না তখন গ্রামের মানুষজন বাংলাদেশের প্রতি সহানুভুতি প্রকাশ করে। কিন্তু কোন পাকিস্তানী সৈন্যকে দেখলে বলে “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”।এক গ্রামবাসী বলেছে এটা তাদের জীবন বাচানোর কৌশল।”

 

দখলদারদের গৃহযুদ্ধের অপ্রপ্রচার

 

ইয়াহিয়া খানের শ্বেতপত্রে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে ২৫ মার্চ তারিখের পূর্বে বাংগালির হাতে কোন অবাংগালি মারা গেছে তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর এই অপ্রপ্রচার কেউ বিশ্বাস করেনি।

অন্যদিকে, এসোসিয়েটেড প্রেস এর প্রতিনিধি Denois Neeld যিনি খবর আদানপ্রদানের নিষিদ্ধ সময়টাতে ঢাকাতে ঘুরে গিয়েছিলেন তিনি ১৯৭১ এর এপ্রিল মাসে লিখেছেন,  “পশ্চিম পাকিস্তানের নন বাংগালী অধিবাসীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে লুটপাট ও খুন করছে। সেনাবাহিনী নিস্ক্রিয় থাকছে অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে  সরাসরি সহযোগিতা করছে অবাংগালীদের এই ধ্বংসযজ্ঞে।”

১৯৭১ এর ১২ জুলাই লন্ডনের টাইমস পত্রিকা লিখেছে, “ সেনাবাহিনীর তৎপরতার পক্ষে পাকিস্তান সরকার ব্যাপক অপ্রপ্রচার চালিয়েছে এই বলে যে বিহারীদের উপর ব্যাপক গণহত্যা চলেছে এবং পাকিস্তানী সেনারা আসার আগে অবাংগালিদের উপর ব্যাপক আকারে হত্যাযজ্ঞ হয়েছে।”

এই ব্যাপারটি সহজেই ব্যাখ্যাযোগ্য। পাকিস্তানী সেনাদের দাবি অনুযায়ী এত বড় হত্যাযজ্ঞ চলবে আর পূর্ব পাকিস্তানে ২৬ মার্চ বিতাড়ণের আগ পর্যন্ত অবস্থানরত কোন বিদেশী সাংবাদিকের নজরে এর কোন খবর আসবে না-এটি বিশ্বাসযোগ্য নয়।

 

শরণার্থীরা কখন ফিরবে?

প্রায় ৮০ লাখ শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করেছে এবং প্রতিবেশীদেশ ভারতের নানা স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।তারা তীব্র ভয় ও সন্ত্রাসের শিকার হয়ে তাদের বাড়িঘর ত্যাগ করেছে।

 

তারা শুধু ভয় এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য তাদের ঘর-বাড়ী ত্যাগ করেছে। প্রতিনিয়ত নির্যাতন এবং ত্রাসের রাজত্বে বাস করে যারা বাংলাদেশ ত্যাগ করতে পারেনি তাদের অবস্থাও সঙ্কটজনক।

 

গত ১৪ই জুন, দ্যা গার্ডিয়ান তাদের একটি সম্পাদকীয়তে লিখেছে, ‘মৃত্যু, আশ্রয়ের আশা ও ভয় ৪ থেকে ৫ মিলিয়ন রিফিউজিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে নিয়ে গেছে। …….. তারা আরও লিখেছে, প্রায় লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা ইয়াহিয়ার বেয়নেটের নিচে আছে, তারা সংকীর্ণ, দূর্দশাগ্রস্থ ও প্রায় অনাহারে দিনযাপন করছে।’

 

২৭ শে জুন, লন্ডনের দ্যা অবজারভার পত্রিকায় কলিন স্মিথ লিখেছেন, ‘যেসব রিফিউজিরা শরনার্থী শিবির থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরতে চান, তাদের জন্য সেনাবাহিনী অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলেছে। মি. বট্টমলেই এবং তার দল এমন একটি ক্যাম্প পরিদর্শন করেন এবং ২২ জন বিধ্বস্ত মানুষ দেখতে পান। পাকিস্তানিরা একদিনে ৫০০ মানুষ আশা করছে।’

 

জুলাই/৭১ এর লন্ডনের দ্যা সানডে টাইমসে মুররে সেইলস লিখেছেন, “পাকিস্তানের মিলিটারি শাসন সম্প্রতি পুনরায় দাবী করেছে যে, দীর্ঘ সামরিক অপারেশনের পর পাকিস্তান দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসছে। …… হাজার হাজার রিফিউজি পালিয়েছে এমন একটি জায়গায় আমি এক সপ্তাহ ছিলাম এবং দেখেছি এ বক্তব্য মিত্যা। প্রকৃতপক্ষে, এমন রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে যেন রিফিউজিরা আর কখনোই ফেরত আসতে না পারে।”

 

ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের সদস্য রেজিনাল্ড প্রেন্টিস বাংলাদেশ ও ভারত সফর করে, ১৬ জুলাই দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকায় লিখেন, “আমরা যেখানেই গিয়েছি, রিফিউজিদের প্রশ্ন করেছি, এবং সব জায়গাতেই একই উত্তর পেয়েছি। আর্মিরা তাদের গ্রামে অথবা তাদের পাশের গ্রামে এসেছিল, মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, অঙ্গচ্ছেদ করা হয়েছে, ঘর বাড়ি ও খামার জ¦ালিয়ে দেয়া হয়েছে, নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, সৈনিকরা বাঙালিদের (বিশেষ করে হিন্দুদের) মালামাল লুট করেছে অথবা অবাঙালিদের দিয়ে বাঙালিদের মালামাল লুট করাচ্ছে। এসব এখনও ঘটছে, তাই তারা সব ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। তারা ফিরতে চায়, কিন্তু যখন তা নিরাপদ হবে, অথবা শেখ সাহেব নিরাপদ বলবেন অথবা যখন আর্মিরা চলে যাবে।”

 

২১ শে জুলাই লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকা লিখেছে রিফিউজিদের মধ্যে হিন্দু মুসলমান উভয়েই ছিল, “আগরতলা থেকে ১৯ মাইল দূরে এবং বর্ডার থেকে মাত্র ২০ ইয়ার্ড দূরে কানতলা ক্যাম্পে প্রায় ২০,০০০ মুসলিম রিফিউজি রয়েছে। তারা সবাই পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরের গ্রাম থেকে এসেছে।”

 

২১ শে জুলাই ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন লিখেছে, “বিদেশী সাংবাদিকদের একটি দল যারা সম্প্রতি আসাম ও ত্রিপুরার দূরবর্তী অঞ্চল ঘুরে এসেছেন তারা বলেছেন অনেক পূর্ব পাকিস্তানি রিফিউজি তাদের বলেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা মুসলিমদের গ্রাম ও মালামাল লুট হয়েছে এবং মুসলিম নারীরা ধর্ষিত হয়েছে।”

 

মুক্তি বাহিনী

 

প্রতিরোধ থেকে বিজয়ঃ

মুক্তি বাহিনী, বাংলাদেশের জনগণের স্বতস্ফূর্ত প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে যার উৎপত্তি সেটি এখন এখন একটি সুসংগঠিত বাহিনী। এটি শক্তি ও আকার, দুটিতেই বৃদ্ধি পেয়েছে। সবদিক থেকেই এটি নিজেকে সক্ষম মুক্তি বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং নিঃসন্দেহে বিজয় নিয়ে আসছে। মুক্তি বাহিনী জনগনের সমর্থন উপভোগ করছে এবং প্রতিদিন ধারাবাহিকভাবে অধিক সাফল্য অর্জন করছে। বিশ^ ধীরে ধীরে এ সত্যটি অনুধাবন করছে।

 

১৫ ই এপ্রিল দ্যা ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সিলেট থেকে ফিরে ডেভিড লোসাক লিখেন, “তাদের ক্ষতি অনেক বেশী,অপূরনীয় কিন্তু হাজার হাজার বাঙালীরা তাদের মৃত্যুকে পরোয়া না করে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আমি চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তাদের অটল মনোবল লক্ষ্য করেছি এবং তারা যে মৃত্যুর জন্য সবসময় প্রস্তুত সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।”

 

১৮ ই এপ্রিল লন্ডনের দ্যা সানডে টাইমস লিখে, “পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অনিবার্য। অখন্ড পাকিস্তানের কাঠামোতে যেটি শুধু অর্থনৈতিক স্বায়ত্বশাসনের আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল সেটি গণহারে পূর্ব পাকিস্তানি নাগরিকদের হত্যার মধ্য দিয়ে এমন এক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে যা আগে বা পরে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি করবে। বাংলদেশ এখন শুধু সময়ের ব্যর্পা।”

 

২০শে জুন লন্ডনের দ্যা সানডে টাইমস লিখেছে, “ঘনঘন গ্রেনেড বিষ্ফোরণ ঢাকাকে প্রকম্পিত করছে, স্পষ্টতই যা মুক্তি ফৌজের কাজ। ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী বেশীরভাগ তরুণই মুক্তি ফৌজে যোগ দিয়েছে। তাদের মনে সুদূরপ্রসারী ভয় আছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে তরুণ হলেই হত্যা করা হবে। তারা এই আশাও ব্যক্ত করেছে যে, তারা হয়ত একদিন স্বাধীন বাংলাদেশে বাস করতে পারবে।”

 

২৩ শে জুন মার্টিন উল্লাকট লন্ডনের দ্যা গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছেন, “শুধু সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে নয়, ঢাকার বাইরেও মুক্তিফৌজের গেরিলা দল যাদের ঘাঁটি এখনো প্রদেশের ভিতরে আছে তাদের যুদ্ধের মুখে অরক্ষিত যোগাযোগ ব্যবস্থা অথবা গ্রাম অর্থনীতি রক্ষা করা  সেনাবাহিনীর পক্ষে প্রায় অসম্ভব কাজ।”

 

৬ই জুলাই লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় ক্লেয়ার হলিংওয়ার্থ একটি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদল যারা মুক্তিফৌজের সাথে সামনাসামনি যুদ্ধ করেছিল তাদের বরাত দিয়ে বলেন, বাংলাদেশী গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা দিনদিন বাড়তে থাকায় আর্মড ফোর্সের অবস্থান ক্রমে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।” তিনি ঢাকা থেকে ফিরেও একই কথা লিখেন, “এবং গেরিলাদের নিরন্তর চেষ্টা ও সমন্বয় সাধনের ফলে, গেরিলাদের ৫ বছর এমনকি এক দশক লাগলেও বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ হবেই; কারণ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে তাদের দেশের জনগনের সর্বময় সমর্থনের ফলেই নির্বাচনে ৯৬% ভোট পড়ে।”

 

১৩ই জুলাই সিডনি স্ক্যানবার্গ নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেন, কিছুদিন আগেই কুমিল্লার বাইরে গেরিলারা একটি রেলব্রিজ উড়িয়ে দেয়। অস্ত্রধারী গার্ডসহ একটি মেরামতকারী ট্রেন পাঠানো হয় ঘটনাস্থলে। গেরিলারা দিবালোকেই মেরামতকারী ট্রেনের উপর আক্রমণ করে, এক বন্দুকধারীকে হত্যা করে এবং একজনকে জিম্মি করে। ট্রেনটি দ্রুত শহরে ফিরে যায়।”

 

স্ক্যানবার্গকে ঢাকা থেকে বহিষ্কার করার পর তিনি ১৫ই জুলাই আবার লিখেন, “গেরিলারা (মুক্তিবাহিনী) সম্প্রতি ঢাকার ভিতরে এবং বাইরে বেশ কয়েকটি রেইড দিয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ স্টেশনে হামলা চালিয়েছে, অস্ত্র কারখানায় হামলা চালিয়েছে এবং মোটর লঞ্চকে সেনাবাহিনীর গানবোটে রূপান্তর করে এমন একটি প্ল্যান্ট ধ্বংস করেছে। এই সংবাদদাতা আরো জেনেছেন যে, দরিদ্র বাঙালি গ্রামবাসী, দিনে এনে দিনে খায় এমন লোকেরাও প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীকে তুচ্ছ করে বিদ্রোহীদের অভিবাদন জানাচ্ছে এবং তাদেরকে সাহায্য করার আশা প্রকাশ করছে।”

 

সিডনি শেনবার্গ নিউইয়র্ক টাইমসে ১৬ জুলাই,১৯৭১ এ লিখেছে,”এখন পর্যন্ত বিশৃঙ্খল বাঙ্গালি হিসেবে প্রেরণা অর্জনে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন প্রতীয়মান হয়।গেরিলারা সম্মুখ যুদ্ধ এড়িয়ে চলছে কিন্তু একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আহত নির্যাতিত হয়েছে।” “সবচেয়ে বড় আক্রমণ হয়েছে সিলেট, কুমিল্লা,নোয়াখালী জেলার পূর্ব সীমান্তে।উল্লেখ্য পরবর্তিতে গেরিলারা ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যে ছিন্নকারী গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা এবং রেলসংযোগ অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে।”

 

ক্লেয়ার হলিংওয়ে ঢাকা থেকে ডাকযোগে লন্ডনের দৈনিক টেলিগ্রাফে ২১ জুলাই লেখেন, ঢাকা বিদ্যুৎহীন কেননা সোমবার নিশিহত্যায় গেরিলারা ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দেয় একই সময়ে ১৩ জন রক্ষীবাহিনী। আর্মি অভিজ্ঞরা বলেন গেরিলারা জানে ঠিক কোথায় আক্রমণ করলে সর্বোচ্চ ধ্বংস হবে।এটি কয়েকমাস সময় নিবে নতুন ট্রান্সফরমার আমদানি করতে ও ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা মেরামত করতে।”

 

দ্যা টাইমসের সংবাদদাতা ২২ জুলাই,লন্ডন থেকে লেখেন,” পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে নতুন ধাপ শুরু হয়েছে।বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ এর সাথে কিছুদিন অতিবাহিত করার পর, পাকিস্তানি আর্মিদের সহজে যুদ্ধে মানিয়ে নিতে দেখিনি।”

 

লন্ডনের দৈনিক টেলিগ্রাফ ২২ জুলাই লেখে,”শহরের ভিতরে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অন্তর্ঘাতকেরা এখন ৩ অথবা ৪ জনের ছোট ছোট দল পরিচালনা করছে যাদের বেশ বাঙ্গালি গরিব গ্রাম্যদের মতো।

 

দ্যা টাইমসের সংবাদদাতা  ২৩ জুলাই,লন্ডন থেকে লেখেন,” পূর্ব পাকিস্তান মুক্তিবাহিনী ১৫০০০ এবং ২০০০০ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য হত্যার দাবি করে আরো অনেককে মারাত্মকভাবে ঘায়েল করে যেন তারা আহত হয়ে হাসপাতালে ঢলে পড়ে। একটি বিশেষ সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্ণেল এম.এ ওসমানী আমাকে বলেন, পাকিস্তান আর্মি দ্বারা ক্ষয়ক্ষতি ভোগান্তির কথা তাৎক্ষনিকভাবে বলেন।

 

বিভিন্নভাবে নিয়ে,পূর্বের মুক্তিফৌজের কমান্ডারগণ, আমি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি যদি তাদের অনুমান ভিন্ন হয়।কিন্তু যদি তারা ঝোঁকের বশে কোনোকিছু চিন্তা করে কর্ণেল ওসমানীর অনুমান সন্দেহাতীত সংরক্ষণশীল।

 

দৈনিক টেলিগ্রাফে পিটার গিল ২৩ জুলাই লন্ডন থেকে লেখেন, ” বাংলাদেশের গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তানের যশোর জেলার ভারত সীমান্তের কাছে ১৫০ বর্গমাইল এলাকা অধিকারে নিয়েছে।”

 

ক্লেয়ার হলিংওর্থ ২৫ জুলাই সানডে টেলিগ্রাফ, লন্ডন-এ লেখেন,’পাকিস্তান আর্মি গতকাল কয়েক ঘণ্টার জন্য দক্ষিণ ও পশ্চিমের জন্য ঢাকার যানত্যাগ বন্ধ করে দেয়।একজন অধিনায়ক নম্রভাবে ব্যাখ্যা করেন যে, ফতুল্লার রাস্তাটি বন্ধ ছিল কারণ সামনে যুদ্ধ চলছিল।’

“গতকালই রাস্তাগুলো পুনরায় খুলে দেয়ার পর,শুধুমাত্র একটি বড় অসামরিক লরি গোলাগুলির মধ্যে ধ্বংস হয়েছিল,পাকিস্তানি আর্মি ও গেরিলাদের মধ্যে ঠিক কি ঘটেছিল তা স্পষ্টত দূর্বল সাক্ষ্য।গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফতুল্লা একটি স্থান যা ঢাকায় প্রাপ্য নিম্নবিদ্যুৎ বর্তমান সোমবার থেকে দেখাশোনা জরুরি, যখন শহরের দুটি বড় বড় উপকেন্দ্র বাংলাদেশি গেরিলা দ্বারা ধ্বংস হয়েছে।”

 

মুরে সাইল ঢাকা থেকে ডাকযোগে ১ আগস্ট, সানডে টাইমসে লেখেন, পি আই এ ফ্লাইটকে উল্লেখ করে ঢাকা এবং করাচির মধ্যে ভারি আর্মি হতাহতদের বহন করা হচ্ছে।” রোগীরা যোদ্ধা,পশ্চিম পাকিস্তানে বাড়ি যাচ্ছে কারণ ঢাকার মিলিটারি হাসপাতাল পরিপূর্ণ। ” সে বলেছিল” গত সপ্তাহে আমার ফ্লাইটে ৬ টা ছিল, দুইজনের পা বোমায় উড়ে যায়,বাকি চারজন গোপন আক্রমণে ধরা পড়ে,শরীরের উপরের দিকে বুলেট বিদ্ধ হয়। মাঝেমাঝে,আমি বলছিলাম,পি আই এ’র প্লেনগুলোর এক-চতুর্থাংশ মারাত্মক জখম জোয়ানে পূর্ণ ছিল।”তিনি আরো লেখেন,” গেরিলারা ইতোমধ্যে ভালো ফলাফল করেছে যা কোনো ভিয়েতকংয়ের করা একটি সংরক্ষিত যুদ্ধে উচ্চ আশাপ্রদ রেকর্ড।”

 

দ্যা টাইমস,৫ আগস্ট ১৯৭১,লুইস হেরেন থেকে ডাকযোগে প্রাপ্ত লেখে, নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদন এটাই আছে যে,মুক্তিবাহিনী অথবা মুক্তিফৌজ সবচেয়ে ভালো কৌশলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থনীতিকে স্থির করার জন্য।

 

ক্লেয়ার হলিংওর্থ,দৈনিক টেলিগ্রাফে ৫ আগস্ট ১৯৭১ এ লেখেন,পূর্ব পাকিস্তানের খারাপ অবস্থা মুক্তিফৌজের মতো অনুভবনীয় ভাবে বৃদ্ধি পায়,বাংলাদেশের গেরিলারা তাদের অপারেশন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করে।’সেই রাতের বিস্ফারণ তীব্র এবং ঘন হতে থাকে।পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্লান্ত।চার মাসেরও বেশি সময় ধরে তাদের কোনো বিরতি ছিলনা এবং তারা একটি অদ্ভুত পরিবেশে কাজ করছিল।সীমান্তের উপর তারা মুক্তিফৌজের কামানের গোলা এবং অন্যান্য হয়রানির শিকার হয় যে তাদের প্রশিক্ষণের ফলাফল দেখতে শুরু করেছিল।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা : একটি বাস্তবতা

 

রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব অস্তিত্ব। বিশ্ব সম্প্রদায়ের স্বীকৃতি এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।মানুষের ইতিহাস এবং অর্থনীতিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্ররর ভিত্তি আছে।

লন্ডনের দ্যা স্পেক্টেটর ১৭ এপ্রিল লিখেছে, রাজনৈতিকভাবে,অর্থনৈতিকভাবে,সামাজিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শাসন করে যারা উভয় পাকিস্তান শাসন করলেও পূর্ব পাকিস্তান অবহেলিত হয়; এবং অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে,পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীরা বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীনতা চাইতেই পারে।

 

পিটার হেজেনহার্শ বাংলাদেশের একটি বিমুক্ত এলাকা থেকে দ্যা টাইমস, ১৯ জুন,লন্ডন-এ ডাকযোগে লেখেন, ” প্রাক্তন পাকিস্তান আর্মি ক্যাপ্টেন অনড় যে,মুক্তিবাহিনী স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনো রাজনৈতিক মীমাংসা গ্রহণ করবেনা।২৫ শে মার্চ আর্মিরা যা করেছে তার পরে আর কোনো পিছুটান থাকতে পারেনা।আমরা অনেক প্রাণ হারিয়েছি,এবং আমাদের অনেক মানুষই জানেন না তাদের পরিবারের সাথে কি ঘটেছে। পূর্নাঙ্গ স্বাধীনতার জন্য এটি এখন একটি সংগ্রাম। ”

 

প্যারিস উচ্চশিক্ষা ইন্সটিটিউট এর পরিচালক, লুইস ডুমেন্ট,৬ আগস্ট লে মন্ডে-তে লেখেন যে,পূর্ব পাকিস্তান ফলতঃ স্বাধীন এবং পাকিস্তান সরকারকে দেয়া সকল সহায়তা বন্ধ করতে ফ্রান্সকে তাড়না দেন, কারণ সরকার তার সংখ্যাধিক্য নাগরিকদের বিরুদ্ধে গিয়ে এর ন্যায্যতা হারিয়েছে।

 

বৃটিশ সংসদ সদস্য ব্রুস ডগলাস মান,৯ জুন ১৯৭১ সাধারণ কক্ষে বলেন, ” এটা সন্দেহাতীত ভাবে সত্য যে,প্রত্যেক জনগণ ইচ্ছাকৃত ভাবে ধ্বংসাত্মক হয়েছে।তারা তাদের দেশকে সন্ত্রস্ত যুদ্ধকৌশলের দিকে তাড়িত করেছে যার একমাত্র ফলাফল সম্ভব, এবং এটাই বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা। ”

 

তিনি আরো বলেন,”২৫ শে মার্চ রাত অবধি এটা আবশ্যক ছিলনা কিন্তু যা করা হয়েছে তার ফলশ্রুতিতে, প্রকৃতভাবে  পাকিস্তানের পুনঃসভা বা পুনর্মিলনের প্রশ্নই এখন অর্থহীন। পাকিস্তান মৃত। এখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে কবর দেয়া হয়েছে এবং আমি ভীত যে, আমরা এখনো প্রকৃত খারাপটা দেখিনি।”

 

” আমি বলছি যে, পাকিস্তান একটি এককে এবং অস্তিত্বে মৃত। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মুক্তির সম্ভাবনার জন্য একমাত্র সমাধান যা সরবরাহ করা হবে,অর্থনৈতিক ভাবে চাপ ও অনুমোদন দ্বারা পশ্চিম পাকস্তান আর্মির উপত বল প্রয়োগ করা।”

 

কক্ষ প্রতিনিধি জনাব গালাঘার ৩ আগস্ট ১৯৭১ এ একটি বিবৃতিতে বলেন,”পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধের সহ্যক্ষমতা সীমা ছাড়িয়েছে।এই অপ্রিয় শাসনের বিরুদ্ধে কিছু মানুষের বিদ্রোহ জেগে উঠেছে।পাকিস্তান আর্মি এ যুদ্ধ জিততে পারবেনা।যুদ্ধরত আর্মিদের জন্য সেকেলে ঔপনিবেশিক যুদ্ধ,নিজভূমি থেকে অনেক দূরে ৭৫ মিলিয়নের একটি সুবিশাল জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই আদিম আক্রমণ বেমানান। পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা হয়ত রাজনৈতিক পূনর্মিলন ও সন্ধি-আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীনতার মীমাংসা অনেকদূর গড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রশ্ন হচ্ছে এই যুদ্ধ কতদূর চলবে?”