2

রেসকোর্স ময়দানে গণপ্রতিনিধিদের শপথ

শিরোনাম সূত্র তারিখ
রেসকোর্স ময়দানে গণপ্রতিনিধিদের শপথ দৈনিক ইত্তেফাক  ৪ জানুয়ারি, ১৯৭১

 

 

গণপ্রতিনিধিদের শপথ

শোষণমুক্ত সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়ার সংকল্প

( ষ্টাফ রিপোর্টার )

 

মুক্ত শপথে দীপ্ত বীর বাংগালীদের নির্বাচনোত্তর সাগ্রহ প্রতীক্ষার অবসান ঘটাইয়া বাংগালী তথা কোটি কোটি মানুষের কামনা- বাসনার পিলসুজে সম্ভাবনার অনির্বাণ শিখা প্রজ্জ্বলিত করিয়া প্রাণ প্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ দলীয় ও নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যরা প্রত্যয়দৃঢ় কন্ঠে গতকাল (রবিবার) রমনা রেসকোর্স ময়দানের অবিস্মরণীয় ও অভূতপূর্ব গণ -মহাসাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়াইয়া অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির অবসা ঘটাইয়া শোষণমুক্ত সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়িবার ঈস্পিত কঠিন শপথ গ্রহণ করেন।

“আমরা শপথ করিতেছি –

“আমরা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামীলীগ দলীয় নবনির্বাচিত সদস্যবৃন্দ শপথ গ্রহণ করিতেছি পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার নামে ;আমরা শপথ করিতেছি সেই সব বীর শহীদদের ও সংগ্রামী মানুষের নামে যারা আত্মাহুতি দিয়া ও চরম নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করিয়া আজ আমাদের প্রাথমিক বিজয়ের সূচনা করিয়াছেন।

 

“আমরা শপথ গ্রহণ করিতেছি এই দেশের কৃষক শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের তথা সর্বশ্রেণীর জনসাধারণের নামে :

 

  • জাতীয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে এই দেশের আপামর জনসাধারণ আওয়ামীলীগের কর্মসূচী ও নেতৃত্বের প্রতি যে বিপুল সমর্থন ও অকুন্ঠ আস্থা জ্ঞাপন করিয়াছে, উহার মর্যাদা রক্ষাকল্পে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করিব ;
  • ছয় দফা ও এগারো দফা কর্মসূচীর উপর প্রদত্ত সুস্পষ্ট গণরায়ের প্রতি আমরা একনিষ্ঠ ভাবে বিশ্বস্ত থাকিব এবং শাসনতন্ত্রে ও বাস্ত প্রয়োগে ছয় দফা কর্মসূচী ভিত্তিক স্বায়ত্বশাসন ও এগারো দফা কর্মসূচীর প্রতিফলন ঘটাইতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করিব ;
  • আওয়ামীলীগের নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীর প্রতি অবচল আনুগত্য জ্ঞাপন পূর্বক আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির অবসান ঘটাইয়া শোষণমুক্ত এবং অন্যায় অবিচার বিদূরিত করিয়া সত্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাইয়া যাইব ;
  • জনগণ অনুমোদিত আমাদের কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্র‍য়াসী যে কোন মহল বা অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা প্রবল প্রতিরোধ আন্দোলন গড়িয়া তুলিব এবং সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা কল্পে যে কোন প্রকার ত্রাণ স্বীকার করত : আপোষহীন সংগ্রামের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকিব। আল্লাহ তায়ালা আলাদের সহায় হউন। জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান।”

 

 

গতকাল(রোববার) বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ দলিয় ১৫১ জন জাতীয় পরিষদ এবং ২৬৮ জন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদ সদস্য ৬ দফা ও ১১ দফা বাস্তবায়নের সংকল্প ঘোষণা করিয়া শপথ করেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমাম অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। সম্ভবত পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই ধরনের গণ শপথ গ্রহণ এই প্রথম।

শেখ মুজিবের ডানপার্শ্বে জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ এবং বাম পার্শ্বে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যগণ দাড়াইয়া শপথ গ্রহণ করেন। প্রত্যেকের বাম হাতে শপথনামা এবং ডান হাত শপথের ভঙ্গিতে উদিত ছিলো। নেতার সঙ্গে সঙ্গে সকল সদস্য শপথনামা পাঠ করেন। শপথ পাঠ করার পূর্বে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, জনপ্রতিনিধগণ জনগণের সামনে জনসাধারণকে স্বাক্ষী রেখে শপথ গ্রহণ করিতেছেন। শপথগ্রহণ সমাপ্ত হইলে বিপুল জনতা উল্লাসে ফাটিয়া পড়ে।

“সহযোগীতা চাই, কিন্তু নীতির প্রশ্নে আপোস নাই”
(স্টাফ রিপোর্টার)
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকাল রবিবার রেসকোর্সের বিশাল গণসমাবেশে ভাষণদানকালে বলেন যে, শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্নে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের গণপ্রতিনিধিদের সহযোগীতা গ্রহণ করতে আগ্রহী, কিন্তু নীতির প্রশ্নে কোনো আপোষ করা হইবে না। তিনি বলেন শাসনতন্ত্র ৬ দফার ভিত্তিতেই হইবে। কেউ ঠেকাইতে পারিবে না।

শেখ সাহেব বলেন, আমরা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। শুধু বাংলারই নয়, আমরা সারা পাকিস্তানেরই মেজরিটি। আমরা যে শাসনতন্ত্র রচনা করিব সেটাই জনগণ গ্রহণ করিবে এবং উহা বানচালের অধিকার কাহারো নাই। তিনি বলেন, মরহুম নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলিয়াছেন, শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে জনগণের রায়ই শেষ কথা আর সে রায় আমরা পাইয়াছি। শেখ মুজিব বলেন, তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ বলিয়াই আমি একথা বলবো না যে, শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্নে আমরা সহযোগীতা চাই না। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীত্ব বা ক্ষমতার জন্য নয়, আওয়ামী লীগের সংগ্রাম বাংলার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের গরিব জনগণের দাবী আদায়ের জন্য। তাই শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের গণপ্রতিনিধিদেরও সহযোগীতা চাই।

“বাক্সবন্দী করিয়া রাখুন”

শেখ মুজিব সরকার প্রণীত চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাক্সবন্দী করিয়া রাখার জন্য সরকারের নিকট আহবান জানাইয়াছেন।

“সন্ত্রাসবাদীদের সম্পর্কে”

দেশের সর্বত্র শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে সর্বশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়া শেখ মুজিব গণতান্ত্রিক বিজয়কে সুসংহত করার স্বার্থে সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের দালালদের বাড়াবাড়ি দমনের জন্য দেশবাসীকে সদা প্রস্তুত থাকার আহবান জানান। তিনি বলেন, ইউনিয়নে ইউনিয়নে, মহল্লায় মহল্লায় আওয়ামী লীগ গঠন করুন এবং রাতের অন্ধকারে যারা ছোরা মারে তাদের খতম করার জন্য প্রস্তুত হোন। রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে সেই সব বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চোরের মতো রাতের অন্ধকারে মানুষ হত্যা করিয়া বিপ্লব হয় না। বিপ্লব চোরের কাজ নয়।

সন্ত্রাসবাদী ও সন্ত্রাসবাদের দালালদের খতম করার জন্য প্রত্যেক নাগরিককে বাঁশের এবং সুন্দরী গাছের লাঠি বানাইবার পরামর্শ দিয়া শেখ সাহেব বলেন, প্রত্যেকের হাতে আমি বাঁশের নয় সুন্দরী গাছের লাঠি দেখিতে চাই। কিন্তু খবরদার! আমার হুকুম ছাড়া সেগুলি ব্যবহার করিবেন না।