5

মুক্তি সংগ্রামে মায়ের প্রেরণা

মুক্তি সংগ্রামে মায়ের প্রেরণা

 

৪ নভেম্বর, ১৯৭১

মুক্তাঞ্চলেই মায়েদের সভা ডাকা হয়েছিল। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলছিল সভার কাজ। একে একে সবাই বিদায় নিয়ে গেলেন। সারাদিনের খাটুনিতে মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। টেবিলের উপর মাথাটা রেখে চোখ বুজেছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। হঠাৎ পায়ের শব্দে তাকিয়ে দেখি আনুর মা ভাবী এসে দাঁড়িয়েছেন আমার টেবিলের কাছে।

আমাকে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসতে দেখে বললেন, “মাথাটা ধইরছে বুঝি, টিইপ্যা দিমু|” হেসে বল্লাম, “না, তেমন কিছু না, ও এমনি সেরে যাবে।” “না না সরম কইর না, খাডনী পইড়ছে ধরব না ক্যান।” আনুর মা ভাবী সত্যি সত্যি হাত লাগাতে আসছে দেখে রীতিমত শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। বললাম, “তেমন কিছু মাথা ধরেনি। সভা শেষ হবার পর একটু জিরিয়ে নিচ্ছিলাম। যাক ওসব। আচ্ছা ভাবী সভা তো হলো। সবাইকে বললাম এবং সবাই স্বীকার করলেন প্রত্যেকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের জন্য কাপড়, জামা , কাঁথা সেলাই করে দেবেনে। সত্যি, হবে তো?” “অইব না মানে? আইজ থাইক্যা হগলে ল্যাইগা যাইব৷ মুক্তিবাহিনীর ছাওয়ালগুলা আমাগো ছাওয়াল না? ছাওয়ালগো বাঁচান আমাগো ফরজ না?” একটা গর্বিত দীপ্তিতে আনুর মা ভাবীর মুখখানি ঝলমল করে উঠল। মাতৃত্ব ঝরে পড়লো তার কণ্ঠ থেকে। বিস্মিত হলাম এই অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলার তেজস্বিতায়, মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদে। একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা ভাবী, আনুর কোন সংবাদ পেয়েছ?” আনোয়ার ওরফে আনু ভাবীর একমাত্র ছেলে। আর একটি ছেলে ছিলো, নাম হাবিব। কারখানায় কাজ করতো। এ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে দু’বছর আগে। মেয়ে দুটির বিয়ে হয়েছে, যার যার স্বামীর বাড়িতে থাকে। আনুই ছিল ভাবীর কাছে। বোশেখের শেষের দিকে বিয়ে ঠিক হয়েছিলো একটা লক্ষ্মী মেয়ের সাথে। সে বিয়ে আর হতে পারেনি। এরই মধ্যে ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী বাংলাদেশের উপর চালিয়েছে নারকীয় আক্রমণ। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছে সারাটা দেশ। যে মেয়েটির সথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল তার বাবা-মাকে হত্যা করেছে খুনী পাকসেনা। মেয়েটির কোন হদিস নেই। আনু তার মাকে নিয়ে চলে এসেছে মুক্তাঞ্চলে, তার মামার বাড়িতে। এখানে এসে আনু শুধু ছটফট করতো আর বলতো, “মা , আমাকেও কিছু করতে হবে।”

ভাবী প্রথমে ছয় পেতেন, আনুকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন- “আমাকে দেখাই তোর এখন ফরজ কাম।” আনুও বেশীকিছু কথা বাড়াতো না।

একদিন আনু ফিরলো বিকেলে। মুখখানা থমথম করছে। মাকে ডেকে বললো, “শুনছ মা, রিজিয়াকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে।” রিজিয়া মেয়েটির সাথেই তা বিয়ে ঠিক হয়েছিল।

আনুর মা ভাবী আফসোস করেছিল সংবাদটি শুনে কিন্তু তার জন্যে আরও কিছু অপেক্ষা করছিল। আনুই বললো, “মা, আমি মুক্তিবাহিনীতে যাবো। রিজিয়াকে উদ্ধার করবো।”

আনু মুক্তিবাহিনীতে যাবে শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিলেন আনুর মা ভাবী। বোকার মত জিজ্ঞেস করলেন, “রিজিয়াকে উদ্ধার কইরা কি কইরবি?”

“বিয়ে করবো, তার দোষ কি মা? আমারই সাথে তার বিয়ের কথা ঠিক হয়েছিল। আমারই তাকে রক্ষা করা উচিত ছিল। আমি পারিনি। আমারই দোষ ও যদি বেঁচে থাকে আর ওকে যদি উদ্ধার করতে পারি তবে আমি ওকেই ঘরের বউ করে আনব।” আনু লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে বলে ফেলে কথাটি। আনুর মা ভাবী আনুর কথার জবাব দিতে পারেন নি। ঠিকই তো। রিজিয়ার দোষ কি? আজ যদি তার দুই মেয়ের এই অবস্থা হতো? ছেলের কথায় রাগ হয় না। তার – গর্বই হয়। এর কয়েকদিন পরে আনু মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এখন সে আছে পূর্ব রণাঙ্গনে। তারই কুশল জিজ্ঞাসা করলাম ভাবীকে।

“তার লাইগ্যাই ফিরা আইলাম। এইহানে আইবার আগে একখানা চিডি আইছে। তোমর কাছে পইড়া শুনুম বইলা লইয়া আইছি। তোমাগো কথা শুইনতে শুইনতে ভুইলা গেছলাম। মনে হইতে ফিরা আইছি।”

আনুর মা ভাবী তার জামার বুকের ভিতর থেকে একখানা খাম বের করলেন। আটদিন আগেকার লেখা চিঠি। আনু লিখিছেঃ

মা,

কয়েকদিন তোমাকে কোন খবর দিতে পারিনি। কারণ আমাদের দুটো লড়াই লড়তে হচ্ছে। মা, তোমার দুটো ঘাঁটি দখল করেছি। দুটো লড়াইয়ে আমরা ৮১ জন পাকসেনাকে মেরেছি। তোমর দোয়ায় আমাদের কারো গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। জান মা, লড়াইতে যাওয়ার আগে আমি কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে তোমার মুখটা স্মরণ করতাম,আর আমার দেহে শক্তির বান ডাকতো। কেন এমন হয় মা? আমার মনে হয় মায়েরাই সকল শক্তির উৎস। তাইতো আমরা দেশকে মা বলি ডাকি, বলি দেশমাতা। আর একটি খবর বলি মা, একটা ঘাঁটি থেকে আমরা ১৩ জন মেয়েকে উদ্ধার করেছি। বর্বর দস্যুরা ওদের উলঙ্গ করে আটকে রেখে ওদের ওপর বর্বর পাশবিক অত্যাচার করতো। সবগুলো মেয়েই রেজিয়ার বয়সী। উদ্ধার করার পর কি কান্না ওদের। দুইজন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আমিই ওদের বাঁচিয়েছি। জানো মা, ও দুজনের কাছে রিজিয়ার গল্প বলেছি, বলেছি- রিজিয়াকে উদ্ধার করতে পারলে আমি ওকে বিয়ে করবো,সম্মান দেবো। ওরা তাতে কিছুটা সান্তনা পেয়েছে। আমাকে ওরা ভাই ডাকে। ওরাও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমাদের হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাশ্রূষা করে।

মা, আমার দেশকে যাঁরা ধ্বংস করেছে তাদেরে ধ্বংস করবো। আমরা পশুদের সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দেবো। তুমি দোয়া করো মা। আমরা জিতবো, তারপর একদিন তোমার কোলে মাথা রেখে খুউব করে ঘুমাবো।

ইতি  –

তোমার আনু।

পড়া শেষ হলো। আনুর মা ভাবীর চোখে থেকে টস টস করে জলে পড়ছে।

“কেদো না ভাবী, আনু নিশ্চিয়ই ফিরবে। মন খারাপ করো না।” আনুর মা ভাবীকে সান্তনা দিতে গেলাম।

“মন খারাপ না। খুশী লাইগতাছে। আনু আমাগো দেশের লাইগ্যা লড়তাছে। এর থাইক্যা খুশীর আর কী অইতে পারে। কারবালায় কাশেমের মা যুদ্ধে যাওনের আগে পাগড়ী বাইন্ধা দিছিলো। আমিও তারে নিজের হাতে কাপড় পরাইয়া দিছি। আনু আমার কাশেম।” চোখের জল মুছে ফেলে আনুর মা ভাবী হাসলেন। তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে একটা স্বগীয় দীপ্তি।………….

(জেবুন্নাহার আইভি রচিত)