2

শহীদ দিবস উদযাপন সম্পর্কে সরকারী প্রতিবেদন

 

শিরোনাম সূত্র তারিখ
শহীদ দিবস উদযাপন সম্পর্কে সরকারী প্রতিবেদন সরকারী ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৬০

 

প্রেরকঃ জাফর ইকবাল, (EsQ., Csp,)                           জরুরি

ডেপুটি ডিরেক্টর।

 

গভমেন্ট অব পাকিস্তান

ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন

পাকিস্তান সচিবালয়নং.,

ওল্ড ফ্ররেস্ট অফিস বিল্ডিং,জেইল রোড।

নং: ৭০৪/৬১ডিপিইউয়াই, রাওয়ালপিন্ডিতারিখ: ২১শে ফেব্রুয়ারী,১৯৬১।

প্রিয় জনাব আহমেদ,

ডি.বি.আর. শহীদ দিবসের(২১শে ফেব্রুয়ারী)উপর একটি রিপোর্ট আশা করছে,আপনি দয়া করে আপনার মতামত সহ রিপোর্টটি অতি শীঘ্রই প্রেরণ করুন।

 

আন্তরিকতার সহিত।

আপনারই,

জাফর ইকবাল

এ এম এস আহমেদ, (EsQ., Psp.),

ডিরেক্টর,

ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন

গভমেন্ট অব ইস্ট পাকিস্তান

ঢাকা

 

 

 

গোপনীয়/জরুরী

ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকন্সট্রাকশন

    পূর্ব পাকিস্তান,ঢাকা

ডি.নং১২৫ডি.বি.এন.আর                                         ১লা মার্চ,১৯৬১

প্রিয় জাফর ইকবাল,

আমি শহীদ দিবস পর্যবেক্ষণের উপর একটি রিপোর্ট সংযুক্ত করছি।পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের উপর শহীদ দিবস ভাব এবং আবেগের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করেছে। ধ্যান ধারণা উপস্থাপনের মাধ্যমে বামপন্থীরা সবসময়ই এই আবেগকে কাজে লাগিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য,যা আপাতদৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য। ছাত্রদের নিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে একটি বিবাদে জড়ানোই এই বছরের শহীদ দিবসে তাদের লক্ষ্য ছিল। এটি করতে তারা যদি সফল হয়ে থাকে তবে তারা এই অবস্থাকে বর্তমান শাসকদের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধের শুরু হিসেবে কাজে লাগাতো। আমি ধরে নিলাম তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে। শহীদ দিবস উদযাপন ছিল শান্তিপূর্ণ, শৃংখল এবং পরিপাটি, তাছাড়াও মাত্রাতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের মত অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি না করে ছাত্রদের দিবসটি পালন করতে দেয়া ছিল সরকারের বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত।

২. সংযুক্ত রিপোর্ট থেকে লক্ষ করা যাবে যে,বামপন্থীরা যদিও পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন এবং সংসদীয় সরকারের দাবী জানিয়েছিল তারপরও এই বিষয়গুলো কোন পর্যায়েই উত্তাপিত হয়নি।

৩. ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের আগে যে আবেগ প্রজ্বলিত হয় তা খুবই তাড়াতাড়ি দমে যায়। এ বছরও এমনটিই হয়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারী উদযাপনে সুদূর প্রসারী কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি।

৪. যে দুষ্টচক্র ছাত্রছাত্রীদের প্ররোচিত করছে তারা পরিচিত এবং সরকার গুটিকয়েক এই চক্রের বিরুদ্ধে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়ার বিবেচনা করছে। তাদের সংখ্যা অর্ধডজন খানেক

 

 

গোপনীয়

ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চইস্ট পাকিস্তান

                                                                লালবাগ,ঢাকা.

২৩শে ফেব্রুয়ারী,১৯৬১.

নং৩৫৮২

প্রাপক,

এ.কিউ. আনসারী, EsQ.,

সচিব ,গভমেন্ট অব পাকিস্তান,

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ঢাকা।

বিষয়২১শে ফেব্রুয়ারী,১৯৬১ শহীদ দিবস উদযাপন।

১. বিগত বছরের ন্যায়, বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা একত্রিতভাবে শহীদ দিবস উদযাপন করেছে।

যথারীতি ঢাকায় ব্যপকভাবে দিবসটি উদযাপন করা হয়েছে। এখানে কিছু বয়স্ক লোকও সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছে।

২.  পুর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি ১২ই জানুয়ারী ১৯৬১-তে একটি বাংলা পরিপত্র জারি করে যেখানে তাদের দলের কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়,শহীদ দিবস উদযাপনে নিম্নবর্ণিত দাবীগুলো উত্তাপনে:

(১) পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন।

(২) সংসদীয় গণতন্ত্র।

(৩) দাপ্তরিক ভাষা বাংলা করা।

(৪) ২১শে ফেব্রুয়ারী ছুটিরদিন ঘোষণা করা

(৫) শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা।

আরো প্রস্তাব করা হয়,যদি জনগণকে সংহত করে একত্রিত ভাবে দিনটি উদযাপনের চেষ্টা করা যায়,তবে এটি হবে সরকারের বিরুদ্ধে একটি সফল “প্রতিরোধ দিবস”

ঢাকা জেলার সাংগঠনিক কমিটির পক্ষ থেকেও শিক্ষার্থীদের দ্বারা সরকারের সামনে উত্তাপনের জন্য একটি পরিপত্র জারি করা হয় যাতে নিম্নবর্ণিত দাবীগুলো ছিল:

(১) ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারী ছুটিরদিন ঘোষণা।

(২) শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শেষ করা।

(৩) পূর্ব পাকিস্তানের সকল দাপ্তরিক কাজে এবং উচ্চ শিক্ষায় বাংলা ভাষাকেই যাতে মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

৩.  উল্লেখ্য যে,১-১-৬১ তারিখের নারায়ণগঞ্জ শহরের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি একটি গোপন মিটিংয়ে দিবসটি জনগণ এবং তরুণদের সহযোগীতায় যথার্থভাবে উদযাপন করার এবং শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের উপর ছেড়ে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল

৪. ঢাকার তরুণলীগ কর্মীরাও ২৭-১-৬১ তারিখে একটি গোপন মিটিং করে। তারা সিদ্ধান্ত নেয় দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করার এবং ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা শহীদ মিনার সাজানোর উদ্যোগ নেয়। এছাড়াও স্থানীয় বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকাগুলোকে ক্রোড়পত্র ছাপানোর আহবান জানায়।

৫. পত্রিকাগুলো সেই অনুযায়ী রাজি হল কিন্তু তারা কোন প্রকার ক্রোড়পত্র ছাপাতে অস্বীকৃতি জানাল। যদিও দৈনিক ইত্তেফাক এবং সংবাদ, সম্পাদকীয় পাতায় লিখল। সংবাদ পত্রিকাটি অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারে ছবিও ছাপানো হল। সেদিনের জন্য পাকিস্তান অবজারভার,ইত্তেফাক এবং সংবাদ আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের অফিস বন্ধ করে দেয় কিন্তু পরবর্তী দিন পত্রিকা ছাপানোর ব্যবস্থা করে রাখে।

৬. যেহেতু পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপিএসইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়ন(ডাকসু) এবং অন্যান্য হলের উপর কতৃত্বকারী অবস্থানে ছিল সেহেতু তাদের সমর্থকগণ শহীদ দিবস উদযাপনের প্রস্তুতিতে তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখে।

৭. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইপিএসইউ কর্মীরা ১লা ফেব্রুয়ারী ১৯৬১-এ একটি গোপন মিটিংয়ে কর্মসূচীর খসড়া সিদ্ধান্ত নেয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় ডাকসুর সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এবং অন্যান্য হলের ইউনিয়ন এবং ঢাকার অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদলসহ সবাইকে নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে, লিফ্লেট, পোস্টার ছাপাতে, প্রভাত ফেরী বের করতে, শহীদের কবরে পূষ্পর্ঘ্য অর্পণ করতে, শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করতে এবং জ্ঞানার্জনে বাংলা ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে এবং বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে একটি মিটিং আহ্বান করা হবে।

৮. তদনুযায়ী ৮ই ফেব্রুয়ারী,১৯৬১ তে ডাকসুর সহ-সভাপতি,জাহান আরা আক্তার(ইপিএসইউ) এর নেতৃত্বে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের একটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু অফিসে। মিটিংয়ে ডানপন্থী গ্রুপের কিছু প্রতিনিধিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এনএসএফ, এসএফ এবং ইপিএসএল এর প্রতিনিধি থাকলেও বেশিরভাগই ছিল ইপিএসইউর। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত  হয়, শান্তিপূর্ণভাবে শহীদ দিবস উদযাপনের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ভিপি এবং জিএস এর স্বাক্ষরসহ পত্রিকায় বিবৃতি জারি করা, দিবসটি উদযাপনে শিক্ষার্থীদের প্রতি আহ্বান জানানো, ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারী ছুটি ঘোষণা করার জন্য, শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা এবং জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং দাপ্তরিক কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে সরকারকে তাড়া দেয়া।।

ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে প্রভাতফেরীতে অংশগ্রহণ করা,শহীদদের কবর পরিদর্শন করা এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা সহ অনুষ্ঠানের একটি পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী নেয়া হয়। যা পরবর্তী দিন(৯-২-৬১) পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

লিফলেটের মাধ্যমে বিস্তরভাবে প্রচারণা চালানো হয়। জগন্নাথ কলেজে, কার্জন হল, বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে এবং ঢাকা হল মিলনায়তনের কাছে বাংলায় কিছু বেনামী পোস্টার পাওয়া যায়,যাতে যথার্থভাবে শহীদ দিবস পালনের আহ্বান করা হয়। রমনা এলাকার ন্যাশনাল ব্যাংক বিল্ডিং এর পাশে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করার আহ্বান জানানো হয়।

৯. দিবসটির সফলতার জন্য, শিক্ষার্থীরা ২১শে ফেব্রুয়ারী প্রভাতফেরীতে তাদের নিজ নিজ হল এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জড়ো হয়। তারা ভাষা আন্দোলনের শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে এবং তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনারে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে।

 

সলিমুল্লাহ হল,ইকবাল হল,আবদুর রহমান হল এবং জগন্নাত কলেজ প্রাঙ্গনে কাল পতাকা উত্তলন করা হয়।

শিক্ষার্থীরা খালি পায়ে এবং ব্যাজ পড়ে ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আজিমপুর কবরস্থানে স্লোগান দিতে থাকে। কাগজের ব্যাজগুলোতে লেখা ছিল “শহীদ স্মৃতি অমর হউক” এবং “একুশে ফেব্রুরায়ী জিন্দাবাদ” অথবা শুধু কাপড়ের তৈরি ছিল সেগুলো।

যাত্রাপথে,প্রভাতফেরী তারা গেয়েছিল এবং নিম্নবর্তী স্লোগানগুলো দিয়েছিল:

১.“একুশে ফেব্রুরায়ী জিন্দাবাদ”

২.“শহীদ স্মৃতি অমর হউক”

৩.“রোমান হরফে বাংলা লেখা চলবেনা”

৪.“শহীদ মিনার সম্পুর্ণ কর”

৫.“ছাত্র জনতা এক হও”

৬.“২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারী ছুটি ঘোষণা কর”

৭.“ধোঁকাবাজী চলবেনা”

১০. আজিমপুর কবরস্থানে পৌঁছানোর পর তারা,১৯৫২-তে পুলিশের গুলিতে নিহত বরকত এবং সালামের কবরে পূষ্পর্ঘ্য অর্পণ করে।

নিচের লেখাটি বাঁশের মাথায় লাল কাগজে লিখে তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক কবরে রেখে যায়ঃ

“হে আমার দেশ, বন্যার মত, প্রচন্ড অভিজ্ঞতার পলিমাটিকে সরিয়ে এনে একটি চেতনাকে উর্বর করেছি-এখানে আমাদের মৃত্যু ও জীবন সমাধি”

“আমার ভাষা বাংলা,আমি বাঙ্গালী এই মহান বার্তা নিয়ে পুলিশের সামনে দাঁড়িয়েছিল বঙ্গ জননীর সেই প্রিয় সন্তান।”

 

“মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচার তরে,আজিকে স্মরিও তারে”

১১.  কবরস্থান থেকে দুই লাইনে ভাগ হয়ে একশ মেয়ে সহ প্রায় তিন হাজার শিক্ষার্থী ৭.৪৫ মিনিটে স্লোগান দিতে দিতে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। একটি কালো ব্যানারে বাংলা তাদের দাবীগুলো লেখা ছিল। “২১শে ফেব্রুয়ারীকে ছুটির দিন ঘোষণা করা,শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করা এবং জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা”র মত দাবীগুলো লেখা ব্যানারে লেখা ছিল।অন্য একটি ব্যানারে লেখা ছিল,“শহীদ স্মৃতি অমর হউক।” প্রথমটি জগন্নাথ কলেজের এবং দ্বিতীয়টি ঢাকা হলের শিক্ষার্থীরা বহন করছিল।

১২.  ধীরে ধীরে শোভাযাত্রাটি পিলখানা রোড়, ফুলার রোড, নীলক্ষেত রোড, ময়মনসিংহ রোড, আবদুল গণি রোড, ওল্ড গভঃ হাউস রোড, সেক্রেটারিয়েট রোড(মেডিকেল কলেজের আগে) ধরে এগিয়ে ১০টার দিকে মেডিকেল কলেজের গিয়ে শেষ হয়। তারা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে এবং সেখানে জড়ো হয়।

ভবিষ্যতে দিবসটি উদযাপন করতে শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানিয়ে,বক্তব্য দেন ইপিএসইউ’র ঢাকা হলের সাধারণ সম্পাদক তাহেরুদ্দিন ঠাকুর। পুলিশের গুলিতে নিহত বরকতের পিতামাতার পাঠানো একটি চিঠি পড়ে শোনান এ কে এম জিয়াউদ্দিন(ইপিএসইউ)। তারপর ডাকসুর সহসভাপতি জাহান আরা আক্তার নিম্নের রেজুলেশনটি পড়ে শোনানঃ

১. শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করা।

২.  ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারী ছুটি ঘোষণা।

৩.   বাংলা ভাষার উন্নতি বিধানে বাংলা একাডেমি যাতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে,সে আহ্বান করা হয়।

১০টা ১৫ মিনিট থেকে শোভাযাত্রাকারীরা স্থান ত্যাগ করতে শুরু করে।

১৩.  কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ফুল দিয়ে সজ্জিত ছিল। মিনারের উপর একটি বড় কাল পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ফুলগুলো একটি বড় কাপড়ের টুকরো দিয়ে ঢাকা ছিল।শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করার দাবী জানিয়ে কেন্দ্রস্থলে একটি লাল পোস্টার টাঙ্গানো হয়। দিবসটি উদযাপন এবং এর তাৎপর্য নিয়ে মিনারের পাদদেশে হাতে লেখা নিন্মোক্ত নিবন্ধসমূহ ঝুলছিল –

১. চতুষ্কোণ, ঢাকা হল ইউনিয়ন।

২. শিখা, ফজলুল হক মুসলিম হল ইউনিয়ন।

 

৩. পদক্ষেপ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়ন

৪. রাক্তা আক্তার, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়ন।

১৪.  দিবসটি উদযাপনে নেতৃত্ব দেন নিম্নবর্ণিত শিক্ষার্থীরাঃ

১। বদরুল হক(ইপিএসইউ), ইকবাল হল,

২। মওদূদ আহমেদ (পিএসএফ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,

৩। তাহেরুদ্দিন ঠাকুর (ইপিএসইউ), সাধারণ স্মপাদক, ঢাকা হল ইউনিয়ন

৪। দ্বিরেন্দ্রনাথ হালদার (ইপিএসইউ-কর্মী), সহসভাপতি, জগন্নাথ হল ইউনিয়ন,

৫। এ কে এম জিয়াউদ্দিন (ইপিএসইউ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,

৬। অমূল্য কুমার রায় (ইপিএসইউ-কর্মী), সাধারণ স্মপাদক, ডাকসু,

৭। বেগম জাহান আরা আক্তার (ইপিএসইউ-কর্মী), সহসভাপতি, ডাকসু,

৮। এ জেড এনায়েতউল্লাহ খান (ইপিএসইউ)

৯। আবদুল লতিফ মল্লিক, মেডিকেল কলেজ

১০। জাহাঙ্গীর খালিদ (ইপিএসইউ-কর্মী), সহসভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইউনিয়ন,

১১। আমিনুল ইসলাম (ইপিএসইউ), প্রাক্তন সহসভাপতি, ডাকসু

১২। আশরাফ উদ্দিন মাকবুল (ইপিএসইউ), প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু,

১৩। এ এন এম শহীদ ওরফে শহীদ সিং (ইপিএসইউ), সহসভাপতি, ঢাকা হল।

দিবসটি উদযাপনে এ আর ইউসুফ(এন এস এফ)-কেও দেখা যায়।

১৫. এছাড়াও শোভাযাত্রায় যারা এসেছিল তাদের মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী এবং লোকজন আলাদা ভাবে শহীদ মিনারে ফুল দেয়।(১)কাজী জহিরুল হক সন্তান সহ(C.P.-Security Prisoner)(২) কে এম ইলিয়াস (C.P.)(৩)ডাঃ এ করিম (Y.L./N.A.P.)(৪)আব্দুর রহমান (EPSU)(৪)মিজানুর রহমান (Y.L.)(৬)আবদুর রশীদ (Y.L.) (৭) শামসুল আরেফিন(ইপিএসইউ), (৮) শাহ আজিজুর রহমান (ইপিএসইউ), (৯) আলাউদ্দিন আল আজাদ,অধ্যাপক,জগন্নাথ কলেজ,ঢাকা এবং (১০) আনোয়ার জাহিদ (Y.L.) সহ অনেকেই তাদের মধ্যে ছিলেন।

১৬. বাংলা একাডেমী,কার্জন হল,সলিমুল্লাহ মুসলিম হল,ফজলুল হক মুসলিম হল,জগন্নাথ হল সহ আরো কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিকালে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

১৭. বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে বাংলা একডেমী প্রাঙ্গনে আলোচনা সভা হয় এবং একডেমীর পরিচালক ডাঃ সৈয়দ আলী আহসান এর সভাপতিত্বে ৩.৩০-৫.০০টা পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি চলে। উক্ত সভায় সাহিত্যে আগ্রহী প্রায় ৬০ জন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তৃতা করেন।

 

উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিকদের মধ্যে আছেন, ডঃ মোঃ শহিদুল্লাহ, প্রফেসর মুনির চৌধুরী, প্রফেসর আশরাফ সিদ্দিকী, প্রফেসর হাসান জামান(টি.এম), প্রফেসর আবুল কাসেম এবং রওশন আরা বেগম। জীবনের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষার পরিপূর্ণতার জন্য সভাপতি সহ সকলেই এই ভাষার উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির কথা বলনে।

১৮. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সবসময় বড় আলোচনা সভাটি হয় কার্জন হলে। উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন ডাঃ কাজী মোতাহের হোসাইন। উপাচার্যও সভায় উপস্থিত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্থানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব আতাউর রহমান খান(আ.লীগ) এবং পুর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মন্ত্রী, জনাব মাহমুদ আলী(আ.লীগ), সহ প্রাক্তন কিছু রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন।

জগন্নাথ কলেজের প্রফেসর অজিত গুহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালইয়ের প্রক্টরবৃন্দ-প্রফেসর মোফজ্জল হায়দার চৌধুরী, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, ডাঃ জি.সি. দেব এবং জনাব নুরুল মোমেন বক্তৃতা রাখেন। তারা সকলে দিনটির তাৎপর্য নিয়ে কথা বলেন এবং শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করেন ভাষার উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম করতে। নিম্নের রেজুলেশনগুলো পাশ করা হয়ঃ

১। তাড়াতাড়ি শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শেষ করা।

২। ২১শে ফেব্রুয়ারী সরকারী ছুটি ঘোষণা।

৩। দাপ্তরিক এবং জাতীয় জীবনে বাংলা ভাষার ব্যবহার করা।

৪। বাংলা ভাষার প্রচারে বাংলা একাডেমীকে সচল করা।

৫। রপমান লিপি এবং অন্য কোন ভাষা বাংলাতে ব্যবহার সহ্য না করা।

৬। পুলিশের গুলিতে নিহতদের কবরে সরকারী খরচে পোক্কা নির্মাণ করা।

কাজী মোতাহের হোসাইন রেজুলেশনে ব্যবহৃত ভাষা নিয়ে ডাকসু কর্মকর্তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন কিন্তু উপস্থিতির হাত উত্তোলনের মাধ্যমে রেজুলেশন পাশ হয়।

বাংলা গানের মাধ্যমে ভাষা এবং দিবসটির প্রশংসা করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আলোচনা সভার সমাপ্ত হয়।

১৯. এস এম হলের সভায় সভাপতিত্ব করেন হল প্রোভোস্ট ডাঃ এম হক এবং এফ এইচ হল ও জগন্নাথ হল সমূহের হল ইউনিয়ন সহসভাপতি নিজ নিজ হলের সভায় সভাপতিত্ব করেন। একই ধারায় এই সভাগুলোতেও বক্তৃতা রাখা হয় এবং কার্জন হলে যে রেজুলেশন গ্রহণ করা হয় তা এখানেও পাশ হয়।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ লেকচার গ্যালারীতে হওয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ স্টুডেন্টস ইউনিয়ন আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক রনেশ দাস গুপ্ত (C.P./Security Prisoner)। তথ্যটি যাচাই করা হয়েছে।

২০. বিকালে কিছু শিক্ষার্থী মোমবাতি দিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আলোকিত করে।

 

২১. কাল পতাকা উত্তোলন, শোভাযাত্রা করা, স্লোগান দেয়া এবং শহীদ মিনারে সভা করার সিদ্ধান্ত, ৮-২-৬১ তে করা অনুষ্ঠানের কর্মসূচীতে ছিলোনা, যা ৮ম অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে।

এই বছরের দেয়া স্লোগানগুলো প্রায়ই গত বছরের ন্যায়। গতবছরও একটি শোভাযাত্রা করা হয়েছিল। কিন্তু কবরস্থান এবং শহীদ মিনারের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। এই বছর এটি আরো বড় পরিসরে ছিল এবং সচিবালয়ের কাছে সংরক্ষিত এলাকাতেও তারা প্যারেড করে যায়।

২২. শোভাযাত্রা এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সভা এম.এল.-এর নির্দেশনার লঙ্ঘন করছে কিনা তা জানতে চেয়ে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ডিআইইবি, পাবলিক প্রসিকিউটরের সাথে আলোচনা করেন। তার মতামতের একটি কপি সংযুক্ত করা হল। তবে তা তেমন কাজের না।

২৩. পূর্ব পাকিস্তান সরকার ৬ই ফেব্রুয়ারী,১৯৬১-তে মেমো নং. ১১১(১৭)-পোল/এস(১)-এ দিনটির জন্য একটি কর্মপন্থা ঠিক করে দেয়। যদিও সক্রিয় কোন ধ্বংসাত্মক ব্যক্তি বা রাজনীতিবিদের খবর পাওয়া যায়নি। শোভাযাত্রা এবং শহীদ মিনারের সভায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালনকারী শিক্ষার্থীদের উপাচার্য দ্বারা নোটিশ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদেক্ষেপ নেয়ার হুশিয়ারী করতে আমি পরামর্শ করছি।

যদিও বাইরের কোন ব্যক্তিকে শোভাযাত্রা এবং শহীদ মিনারের সভায় নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়নি,তবুও আমরা যাচাই করে দেখছি। যদি এমন কাউকে পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(এ.এস.এ. কবির)

ডেপুটি ইন্সপেক্টর-জেনারেল অব পুলিশ

ইস্ট পাকিস্তান,ঢাকা

 

পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত

বিষয়টি নিয়ে পাবলিক প্রসিকিটরের মতামত ডিআইবি ডিপার্টমেন্টের একজন কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছি এবং আনুষাঙ্গিক কিছু কাগজ পেয়েছি।

ভবিষ্যতের কিছু উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কিছু শিক্ষার্থী দ্বারা রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতায় ২১শে ফেব্রুয়ারী উদযাপিত হয়। বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দলের উপর ইতিমধ্যেই নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেছে। গতকাল(২১শে ফেব্রুয়ারী) শিক্ষার্থীরা যে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেয়। আমার মনে হয় এর সাথে কোন রাজনৈতিক দলের যোগসাজেশ নেই। শোভাযাত্রায় অংশ নেয়াদের যদি কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকে এবং এটি যদি মৃত আত্মার প্রতি সমবেদনার তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হয়ে থাকে, তাহলে শোভাযাত্রাকে কোন ভাবেই রাজনৈতিক বলা যাবেনা। যদি তাদের রাজনৈতিক উদ্দশ্য থাকে, তাহলে অবশ্যই এটি রাজনৈতিক এবং এটি এম.এন.আর নং ৫৫এ.-এর মধ্যে পড়ে।

 

পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী শহীদ মিনারে যে সভা হয় তাতে কোন সভাপতি ছিলনা, কিন্তু সেখানে জনবহুল একটি জায়গায় ছাত্রছাত্রী এবং জনগণের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভাটি যেহেতু অননুমোদিত এবং যা এম.এম.আর নং. ৫৫এ. বিধানের লঙ্ঘন করে।

লিফলেট সম্পর্কে,এটি শহীদ দিবস উদযাপনের বিস্তারিত কর্মসূচী নিয়ে ছাপান। এতে তাদের দাবীর কিছু প্রতিকার ছিল যা তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

স্বাক্ষরিত/মোঃ আবদুল আলিম

পি.পি.ঢাকা

২২-২-৬১